পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি পেমেন্টই (কেন্দ্র ভাড়া) দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদন না করেও অনেক কেন্দ্র অলস বসে থেকে পেয়েছে ভাড়া। এসব কেন্দ্রের বেশির ভাগেরই মালিক ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। তবে বিদ্যুতখাত লুটপাটের মূলহোতা হিসেবে শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর নাম আসছে।
জানা গেছে, ১৫ বছরে বিদ্যুতে ২ লাখ কোটি টাকা লোকসান ও গত ৫ বছরে এলএনজিতে ২৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকিতে ব্যাপক লুটপাট দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে দুর্নীতির মূল হোতা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। হত্যা মামলায় তার ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।
জানা গেছে, টানা ১৫ বছর ধরে তৌফিক-ই-ইলাহীর বিদ্যুতের চেয়ে জ্বালানি খাতে প্রভাব ছিল বেশি। বিশেষ করে গ্যাজপ্রমকে কূপ খননের কাজ দেয়া, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, এলএনজি ও এলপিজি ব্যবসায় সুযোগ বাড়ানোসহ বিভিন্ন কাজে প্রভাব বিস্তার করতেন তিনি। তার পরামর্শেই বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া শুরু হয়। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বেশিরভাগের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য। যদিও তা চলেছে ১২ থেকে ১৫ বছর ধরে। এসব কেন্দ্রের অনুমোদন থেকে নির্মাণের প্রতি ক্ষেত্রেই দুর্নীতির সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার অভিযোগ।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরপত্রের মাধ্যমে আটটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল। ওই বছর আওয়ামী লীগের সরকার বিনা দরপত্রে ৩২টি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়। দরপত্র এড়াতে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে দুই বছরের জন্য পাস করা জরুরি বিশেষ আইন এখনো আছে। এই আইনের অধীনেই ৭২টি রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়।
বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় অংশই পেয়েছেন তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার, ইউনাইটেড, এনার্জিপ্যাক অন্যতম। অভিযোগ আছে, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ দক্ষতায় চালানো হয়েছে। অর্থাৎ কেন্দ্রগুলো বছরের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই অলস বসে ছিল।
দরপত্র এড়াতে বিশেষ আইন: ২০১০ দুই বছরের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সংসদে পাস করা হয় ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন’। এই আইনে করা কোনো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না, যাওয়া যাবে না দেশের আদালতে। পরে আইনটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুতে খুচরায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। বর্তমানে তা
৮ টাকা ৯৫ পয়সা। অর্থাৎ ১৫ বছরে দাম বেড়েছে ১৪২ শতাংশ।
পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে আইপিপি ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় প্রায় সাড়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর পরের পাঁচ বছরে অর্থাৎ, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় প্রায় ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, গত ১৩ বছরে বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র পাওয়ার শীর্ষে রয়েছে সামিট গ্রুপ। এই গ্রুপ গোপালগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের টানা ছয়বারের এমপি ও সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খানদের পারিবারিক ব্যবসা। সামিটের সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, এগুলো পেয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা।
জানা গেছে, কনফিডেন্স গ্রুপ বিনা দরপত্রে ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র পেয়েছে। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার দিক থেকে এই গ্রুপটি তৃতীয় স্থানে রয়েছে, তাদের ছয়টি কেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ৯৬২ কোটি টাকা।
কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাক্যাটের চার বিদ্যুৎকেন্দ্র ৮৮৩ কোটি টাকা। ষষ্ঠ সিঙ্গাপুরভিত্তিক সেম্বকর্প ৭৮৫ কোটি, সপ্তম স্থানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এপিআর এনার্জি ৬৮০ কোটি, নবম স্থানে ডরিন গ্রুপের ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্র ৬৫১ কোটি এবং ১০ম স্থানে দেশ এনার্জির চার বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫১৫ কোটি টাকা।
ডরিন পাওয়ারের মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মৃত নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে ও ঝিনাইদহ থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী তাহজীব আলম সিদ্দিকী। দেশ এনার্জি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মরহুম মেয়র আনিসুল হকের প্রতিষ্ঠান।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিগত সময়ে ‘কাজগুলো যাকে খুশি তাকে দিয়েছেন। তার মানে মনমতো, পছন্দমতো, ইচ্ছামাফিক লোক বা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যে দামে কাজটা করানো হবে, দাম যা দেওয়ার কথা তার থেকে বেশি দেওয়া হয়েছে।’
দেশের বিদ্যুৎ খাত খোলা হয়ে গেছে। ভেতরে কিছু নেই। ক্যাবের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হলেও আমলে নেওয়া হয়নি। এ মুহূর্তে দেশের সব উন্নয়ন বন্ধ রেখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ওপর নজর দিতে হবে, তা না হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত যদি ধসে যায়, তবে গোটা অর্থনীতি বালুর বাঁধের মতো তছনছ হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সব চুক্তি খতিয়ে দেখতে টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। এই টাস্কফোর্স চুক্তি খতিয়ে দেখে বাতিল করার পরামর্শ দেবে এবং কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্টের যৌক্তিক পুনর্মূল্যায়ন করবে। আগামী তিন বছর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো যাবে না। এসব না করা গেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি যে ডুবছে, তাকে আর ভাসানো যাবে না।
এদিকে দেশের জ্বালানি খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় পরিহার করে ভোক্তাবান্ধব করে তোলার লক্ষ্যে আগামী তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম না বাড়ানোসহ ১১ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় রোধ করে ঘাটতি সমন্বয় ও পণ্য মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধ এবং সংকট মোকাবিলা করার লক্ষ্যে তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানির মূল্যহার বৃদ্ধি করা হবে না সরকারের কাছ থেকে এমন ঘোষণা চাই।
সেই লক্ষ্যে বিইআরসির আওতায় ক্যাব প্রস্তাবিত বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২৪ এর আলোকে জ্বালানি খাত সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য একটি ‘জ্বালানি খাত সংস্কার কমিশন’ চাই। সংস্কার প্রস্তাবে বিদ্যুৎ, প্রাথমিক জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় রোধ করে ঘাটতি সমন্বয় এবং ভোক্তার জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণে জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা চাই।
বিইআরসির চেয়ারম্যান পরিবর্তন হয়েছে। সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন। তাদের স্থলে অভিজ্ঞ, নিরপেক্ষ, দক্ষ, সৎ পেশাজীবীদের নিয়োগ সার্চ কমিটির মাধ্যমে চাই। অংশীজনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সার্চ কমিটি গঠন চাই।
জ্বালানি অধিকার সুরক্ষায় জ্বালানি খাতের আওতাধীন বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালনা বোর্ড বা সংস্থাগুলোতে বিভিন্ন পদে পদস্থ ক্যাডার কর্মকর্তাদের অপসারণ চাই। একইসঙ্গে পেট্রোবাংলা, বিপিসি, পিডিবি, আরইবি, স্রেডা এবং বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানি খাতের বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষ পদগুলোর কর্মকর্তাদের পরিবর্তন চাই। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সম্পদ উভয় বিভাগেও অনুরূপ পরিবর্তন চাই। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত পরিচালনায় মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্বের অবসান চাই।
অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি খাতের লুণ্ঠনমূলক ব্যয় পরিহার করতে না পারলে ভোক্তা তার জ্বালানি অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। বিগত সরকার জ্বালানি খাতে যে অলিগার (লুণ্ঠন) করে গেছে, বর্তমানে যারা এখনো জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছে, তারাও সেই অলিগার গ্রুপেরই লোক। তাই জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সেই অলিগলারদের দ্রুত সরিয়ে দিতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা অন্তত তিন বছরের মধ্যে দেশে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম না বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছি। আর এই জন্যে (জ্বালানি খাতের উন্নয়নের জন্য) বর্তমান সরকারকে (অন্তর্র্বতী সরকার) দুই থেকে তিন বছর থাকতে হবে। তাই আমরাও ভোক্তার অধিকার রক্ষায় সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাই। আর জ্বালানি খাত থেকে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় পরিহার করতে চাইলে সামিট-আদানির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে হবে।