ফের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ। এর আগে দুই দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল প্রকল্পটির। কিন্তু গত ৫ বছরে কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ। এখন তৃতীয় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। অভিযোগ উঠেছে যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারায় এখন ৪১ শতাংশ ব্যয় বেড়ে গেছে। ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর ২ হাজার ৩শ কোটি টাকায় এই প্রকল্প অনুমোদন পায়। নানা অজুহাতে এখন ব্যয় বেড়েছে ৮শ কোটি টাকা। অথচ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ-তারা কাজ শেষ না করেই ২৫০ কোটি টাকার বেশি বিল নিয়ে গেছে। এই অবস্থায় ক্ষুব্ধ সরকার প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি ও দায়-দায়িত্ব নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু গত ২ মাস হয়ে গেলেও এ নিয়ে একটি সভাও করতে পারেনি নতুন এই কমিটি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া এই প্রকল্পটির বিরুদ্ধে প্রথম থেকে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ত্রুটির কথা বলে কয়েক দফায় নকশা পরিবর্তন করা হয়। এই ভুলের জন্য প্রকল্পের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রকল্প পরিচালক একাধিকবার লিখিত চিঠি দিয়ে অভিযোগ করলেও রহস্যজনক কারণে বেবিচক তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
একইভাবে সাবেক এক প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) বিরুদ্ধেও ঘুস-বাণিজ্য, খামখেয়ালিপনা ও একগুঁয়েমির অভিযোগ করেছিলেন ঠিকাদার। কিন্তু তাদের অভিযোগও আমলে নেয়নি সরকার। কারণ হিসাবে জানা গেছে, ওই প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন একজন অতিরিক্ত সচিবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এ নিয়েও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
প্রকল্পের ঠিকাদার চীনের বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (বিইউসিজি) কর্তৃপক্ষের বক্তব্য-তারা সব নিয়মনীতি মেনে ২১৩ কোটি টাকার বিল নিয়েছেন। কিন্তু তৎকালীন প্রকল্প পরিচালকের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তারা প্রায় ১ বছরের বেশি সময় কাজ করতে পারেননি। এছাড়া প্রকল্পের নকশা বারবার পরিবর্তন করার কারণে সময় বেশি লেগেছে। নকশা পরিবর্তনের কারণে এক বছর পর্যন্ত তারা একাধিক বিদেশি প্রকৌশলীসহ অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন-ভাতা দিয়ে গেছেন। বিষয়টি মন্ত্রণালয় ও বেবিচককে জানিয়েও কোনো সুরাহা করতে পারেননি। এ কারণে সময় বেশি লেগেছে এবং ব্যয়ও বেড়েছে।
প্রকল্পের আওতায় এখানে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ফুয়েলিং সিস্টেম স্থাপন করার কথা রয়েছে। এছাড়া পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পৃথক সাবস্টেশন স্থাপন, নিরাপত্তার জন্য ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম, যাত্রীদের জন্য এস্কেলেটরসহ আরও কিছু কাজ রয়েছে। এই মেগা প্রকল্পটির মূল কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালে। কিন্তু ওই সময়ে শেষ করতে না পারায় পরবর্তীকালে সময় বাড়ানো হয়। সেই বর্ধিত সময় অনুযায়ী ২০২৩ সালের ২৭ মে কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কাজ শুরু করতে গিয়ে ধরা পড়ে নকশার ত্রুটি। ফলে নতুন করে গত বছর এই প্রকল্পের নকশা তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়। এছাড়া ত্রুটি না ধরে যারা এই নকশা বুঝে নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু অদৃশ্য হাতের ইশারায় থেমে গেছে সব।
এছাড়া এই প্রকল্পের সাবেক এক প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ঘুস ছাড়া কোনো কেনাকাটার অনুমোদন দিতেন না। নিয়ম হলো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঠিকাদার লোকবল নিয়োগ করবে। এই নিয়োগেও ওই পিডির বিরুদ্ধে বাগড়া দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের জন্য বিদেশি প্রকৌশলী, একাধিক কর্মকর্তা ও বেশ কয়েকজন প্রাইভার নিয়োগ করলেও প্রায় এক বছরের বেশি সময় তাদের বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এ কারণে তারা কাজ করতে পারেনি।
গাড়ির ড্রাইভার নিয়োগেও তার অনুমোদন না দেওয়ার অভিযোগ আছে। শুধু তাই নয়, ওই কর্মকর্তা তার গাড়ির ড্রাইভারের বেতন এক লাখ টাকা করার নির্দেশ দিয়েছেন ঠিকাদারকে। তা না মানায় ঠিকাদারের নিয়োগকৃত বিদেশি প্রকৌশলীকে অনুমোদন না দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ-তিনি ঠিকাদারের ভাড়া বাসায় থেকেও সরকারের কাছ থেকে বাসা ভাড়া নিতেন। এ অবস্থায় প্রকল্পের বিদেশি ঠিকাদার বাকি কাজ করবে না বলে হুমকিও দিয়েছিল। বর্তমানে এই প্রকল্পের খরচ ৪১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২শ কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২২ শতাংশ। ২০২৫ সালে নির্ধারিত মেয়াদ অনুযায়ী কাজ শেষ হওয়া নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
বেবিচক সূত্র জানায়, ডিজাইন ত্রুটি ধরতে না পারার সঙ্গে জড়িত বেবিচক প্রকৌশলীদের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণের জন্য ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয় বেবিচক সদস্য (অর্থ) মো. আজিজ তাহের খানকে। কিন্তু এই কমিটি দায়িত্ব পাওয়ার পর কোনো কার্যক্রমই চালায়নি। বেবিচক সদস্য (অর্থ) মো. আজিজ তাহের খান বদলি হওয়ার পর বর্তমান সদস্য (অর্থ) এসএম লাবলুর রহমান দায়িত্ব পান। কিন্তু তিনিও এ নিয়ে কোনো কাজ করেননি এখন পর্যন্ত।
এছাড়া বিমান মন্ত্রণালয় থেকে এই ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন প্রণয়ন ও পরামর্শকের কাছ থেকে যথাযথভাবে বুঝে নেওয়া প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নামের তালিকা চাইলেও তা পাঠায়নি বেবিচক। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রক্রিয়ায় জড়িত তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বহিঃবিমানবন্দর) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর (প্ল্যানিং অ্যান্ড কিউএস) নামসহ প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেন তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক। এরপরও গত ৬ মাসে তা পাঠানো হয়নি মন্ত্রণালয়ে।
জানা গেছে, চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (বিইউসিজি) কাজটি করছে। ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার সিভিল ডিভিশন ৩-এর অধীনে কাজ সুপারভিশন করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে এই ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতিতেই প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়ন হয়নি। এর আগে এই প্রকল্পে পরিচালক হিসাবে ২ জন যুগ্মসচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যাদের প্রকল্প সম্পর্কিত কারিগরি দক্ষতা ও যোগ্যতা ছিল না। তারা ছিলেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাদের অ্যাভিয়েশন সংক্রান্ত কোনো কারিগরি জ্ঞান ছিল না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেবিচকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বেবিচক চেয়ারম্যানসহ আমরা সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। নির্ধারিত সময় ২০২৫ সালে কাজ শেষ না হলেও বেশি সময় লাগবে না। ছয় মাস আগে আমি এই দপ্তরে যোগদান করেছি। তদন্ত কমিটির ব্যাপারে কেউ আমাকে অবগত করেননি। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানা গেছে, মোট ৩২টি বিদেশি কোম্পানি এই প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নেয়। প্রথম দফায় সব কোম্পানির দরপত্র বাতিল হয়ে যায়। দ্বিতীয় দফায় আবার দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেবার মোট ১৯টি দরদাতা অংশ নেন। তাতে ৬টি প্রতিষ্ঠান যোগ্য বিবেচিত হয়। এরপর দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে এই প্রকল্পের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে চীনের বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপকে (বিইউসিজি)।