ব্যাংক থেকে পানির মতো নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত রাখা হয়নি। পুঞ্জীভূত বকেয়া ঋণের বিপরীতে জামানত মাত্র ৫ শতাংশ। ফলে এসব ঋণ এখন ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে। এই অবস্থায় ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকি হ্রাস করতে গ্রাহকদের অন্যান্য সম্পদ ঋণের জামানতের সাথে যুক্ত করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলমের দখলকৃত আট ব্যাংক, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও দেড় দশক ধরে চেয়ারম্যানের পদ দখলে রাখা নজরুল ইসলাম মজুমদারের এক্সিম ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকসহ পুনর্গঠিত ব্যাংকগুলোর বিশেষ পরিদর্শনে শীর্ষ ঋণ গ্রহীতাদের এ চিত্র উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্ট একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে তাদের ব্যাংকে পরিদর্শন শেষ করেছেন। এতে এস আলম, নজরুল ইসলাম মজুমদার, শিকদার গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপসহ শীর্ষ ১০ গ্রুপের ঋণের এমন চিত্র পাওয়া গেছে। তিনি জানিয়েছেন, আগের পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে তা পরিশোধ করেনি। বিপরীতে বছরের পর বছর নতুন ঋণ সৃষ্টি করে পুরনো ঋণ পরিশোধ করেছে। ১০০ কোটি টাকার ঋণে দেয়া হয়েছে ৫ কোটি টাকার জামানত।
পরের বছর ওই একই ঋণ বর্ধিত করে ২০০ কোটি টাকা করেছে। এ থেকে একটি অংশ পুরনো ঋণ পরিশোধ করেছে। পরের বছর একই ঋণ বর্ধিত করে ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এভাবে একটি ব্যাংকের শিকদার গ্রুপের ঋণ বেড়ে আড়াই হাজার কোটি টাকা হয়েছে। কিন্তু জামানত বাড়েনি। ওই একই ব্যাংকে এস আলমেরও ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু যে পরিমাণ জামানত ছিল তা পুঞ্জীভূত ঋণের সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হবে। এভাবে ব্যাংকগুলোতে ব্যাংকের পরিচালক বনে যাওয়া এক শ্রেণীর ব্যাংক খেকো জনগণের আমানত নিয়ে নয়ছয় সৃষ্টি করেছে। অথচ এসব ব্যাংক বছর শেষে খেলাপি ঋণের হার দেখিয়েছে সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৪ শতাংশ। ঋণ পরিশোধ না করে জনগণের আমানত নয়ছয় করলেও প্রভাবশালী পরিচালক বা চেয়ারম্যান হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তেমন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কিছু কর্মকর্তাও দেখেও না দেখার ভান করে চলেছেন। ডেপুটি গভর্নর থেকে শুরু করে গভর্নর পদ পর্যন্ত এসব ব্যাংক খেকোদের সুপারিশে মনোনীত করতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। এ কারণে এসব পদ থেকে অধীনস্থদের ব্যাংক খেকোদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে বাধাগ্রস্ত করা হতো। এভাবে শুধু এস আলম গ্রুপই তার দখলে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার তার দোসরাও গা ঢাকা দেয়। নজরুল ইসলাম মজুমদার, সালমান এফ রহমানসহ অনেকেই গ্রেফতার হলেও অনেকেই পালিয়ে যান। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো দেশ থেকে পালিয়ে যান। কয়েকজন ডেপুটি গভর্নর বিক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবির মুখে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন গভর্নর হিসেবে আসেন দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি গভর্নরের দায়িত্ব নিয়েই এস আলমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মালিকানায় থাকা ৮টি ব্যাংক, নাসা গ্রুপের দখলে থাকা এক্সি ব্যাংক, সালমান এফ রহমানের দখলে থাকা আইএফ আইসি ব্যাংকসহ ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করেন। একই সাথে এসব ব্যাংকগুলো থেকে কে কত অর্থ ঋণের নামে বের করে নিয়েছেন তা ক্ষতিয়ে দেখতে বিশেষ পরিদর্শন করে। এখনো এ পরিদর্শনের কাজ চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোতে জনগণের আমানত নিয়ে পারস্পরিক জোগসাজশের মাধ্যমে এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। আবার এসব ঋণ পরিশোধ না করেই নতুন ঋণ সৃষ্টি করে পুরনো ঋণ পরিশোধ করেছেন। বছরের পর বছর ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করা হয়নি। অথচ এসব ঋণ খেলাপিও দেখানো হতো না। নিয়মিত দেখানো হতো। নিয়মিত ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নিয়ে মুনাফার ওপর সরকারকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ট্যাক্স দেয়া হতো। আবার নিজেরাও মুনাফা ভাগবাটোয়ারা করতো। এভাবে প্রকৃত মুনাফা না করেও ভুয়া মুনাফা ভাগবাটোয়ারা করে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভীত দুর্বল করে ফেলেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতে একমাত্র ইসলামী ব্যাংক ও আল আরাফা ব্যাংক বাদে বেশির ভাগ ব্যাংকই জনগণের আমানত চাহিদা অনুযায়ী ফেরত দিতে পারছে না। বিশেষ করে এস আলমের মালিকানায় থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ। গতকালও ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে সাধারণ গ্রাহকরা আমানত ফেরত পাওয়ার জন্য মিছিল করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যেসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেই ওই গ্রাহকের অন্য স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ ঋণের সাথে যুক্ত করার জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। এ অনুযায়ী শীর্ষ এ ঋণখেলাপিদের মালিকানায় থাকা অন্য স্থাবর সম্পদ খোঁজ করছেন। এসব সম্পদ ঋণের সাথে যুক্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা না হলে এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রমালিকানায় নিয়ে যাওয়া হবে। পরে এসব সম্পদ বিক্রি করে ঋণের অর্থ সমন্বয় করা হবে।