মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ভোজ্যতেল ও ডিমের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক কমানোসহ কয়েকটি বিষয়ে জোরদারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর মধ্যে ডলার সংকটের কারণে সার আমদানি যেন ব্যবহৃত না হয়, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ নিশ্চিত এবং কৃষিঋণের অঙ্ক বাড়ানো হবে। এছাড়া কমিয়ে আনা হবে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যাও। কৃষক ও খুচরা ব্যবসায়ীর মধ্যে অসংখ্য মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে পণ্যের দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। পাশাপাশি সবজির মূল্য কমাতে অমুনাফাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকায় সরবরাহ বাড়ানো ও খোলাবাজারে ডিমসহ কৃষি ওএমএস কর্মসূচি চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ভোজ্যতেলের ওপর ৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করা হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। ডিমের শুল্ক কমানোর বিষয়টি বিবেচনাধীন। পোলট্রি শিল্পের খাদ্যের মূল্য বেশি। সেটি কমিয়ে আনতে যৌক্তিক শুল্ক ও ভ্যাটের প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পণ্যের মূল্য কমাতে যা করণীয় প্রয়োজনে তা করা হবে। তবে এখন বিশ্ববাজারেও পণ্যের দাম বাড়ছে। সে তুলনায় বাজার খুব বেশি বাড়তে দেওয়া হবে না। সেটির ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের ছাড় দিতে বলেছি। এদিকে বাজারে প্রতিটি পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকায়, পেঁপে ও আলু ছাড়া অধিকাংশ পণ্যই একশ টাকার উপরে কেজি বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি লিটার সয়াবিনে দুই টাকা এবং পামওয়েলে ছয় টাকা বেড়েছে। বর্তমান খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি এবং সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। কিন্তু বাজারে মূল্যের এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার কমার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভোজ্যতেল ও ডিমের শুল্ক ছাড় আসছে : সূত্র মতে, মঙ্গলবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। তাদের যৌক্তিকতা হচ্ছে বিশ্ববাজারে গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে সয়াবিন ও পামতেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের মূল্য ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং পাম তেলে ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈঠকে ব্যবসায়ীদের মূল্য সমন্বয় না করে ভোজ্যতেলের ওপর আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ এবং উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আরোপিত সমুদয় মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। এটি এখন এনবিআর কার্যকর করবে। বৈঠকে অবশ্য এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এ ধরনের শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হলে বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য বৃদ্ধি না করে বিদ্যমান মূল্য বহাল থাকবে।
এদিকে সাড়ে চার কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমোদন দেওয়ার পর আশানুরূপ আমদানি হচ্ছে না। যে কারণে আমদানির অনুমতির পরও ডিমের বাজারে সুফল মিলছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, এখন পর্যন্ত সাত লাখ পিস আমদানি হয়েছে। ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানির উপরে থাকা শুল্ককর সাময়িকভাবে প্রত্যাহারের বিষয়টি পর্যালোচনা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-এমনটি জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব। বর্তমান ডিম আমদানিতে মোট ৩৩ শতাংশ শুল্ক-কর রয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন ডিমের শুল্ক ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। সংস্থাটি মনে করছে, এই শুল্ক-কর অব্যাহত রাখলে আমদানি করা ডিম স্থানীয় বাজারে দামের ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব রাখবে না। ট্যারিফ কমিশন চিঠিতে বলেছে, এ জন্য আমদানি পর্যায়ে ডিমের ওপর থাকা শুল্ক-কর স্বল্প সময়ের জন্য প্রত্যাহার করা হলে সাধারণ জনগণ স্বস্তির জায়গা খুঁজে পাবে।
মধ্যস্বত্বভোগী কমিয়ে আনার উদ্যোগ : কৃষক থেকে ঢাকার খুচর বাজার পর্যন্ত পণ্য পৌঁছাতে কয়েক ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ী, বেপারী, ফড়িয়া, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা। প্রতিটি ধাপে আবার রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী। যে কারণে পণ্যের দাম কৃষক পর্যায়ে এক রকম এবং ঢাকার খুচরা বাজারে অনেক বেশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন বাজারের ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনকে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীর সংখ্যা কমিয়ে আনতে নির্দেশ দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটি বাস্তবায়ন হলে পণ্যের দামে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অমুনাফাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ঢাকায় সবজির সরবরাহ বাড়াবে : সহজডটকম নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা সবজি সরবরাহ করবে বলে বার্ণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সবজি সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সহজডটকম প্রতিদিন ৮০ মেট্রিক টন সবজি সরবরাহ করছে দেশব্যাপী। এছাড়া খোলাবাজারে ডিমসহ ১০টি কৃষিপণ্য সরবরাহ শুরু করেছে। মঙ্গলবার কৃষি ওএমএস নামে এ কর্মসূচি উদ্বোধন করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। রাজধানীর ২০টি স্পটে দেওয়া হবে কৃষি পণ্য। এর মধ্যে রয়েছে আলু, কাঁচা পেঁপে, পেঁয়াজ ও বিভিন্ন ধরনের সবুজ শাকসবজি।
সার আমদানিতে ডলার সরবরাহ : কয়েক দিন আগেও ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশকে সার সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর আট কোটি মার্কিন ডলার বকেয়া পড়েছে। এ কারণে চীন, কানাডা, সৌদি আরব ও মরক্কো- এ চার দেশের রপ্তানিকারকরা বাংলাদেশকে সার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। পাশাপাশি বকেয়া বিলের অর্থ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে চাপ প্রয়োগ করছে তারা। উদ্ভূত পরিস্থিতি তুলে ধরে দ্রুত ডলার সংকট সমাধানের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে আধা সরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছেন কৃষি উপদেষ্টা। কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান সম্প্রতি যুগান্তরকে জানান, ডলার সংকট নিরসনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ সচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। মরক্কো ও সৌদি আরবের বকেয়া দিতে পারলে আশা করি, সার আমদানির কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে। তখন দুই থেকে চার দিন পরপর ডলার পেলেও তেমন সমস্যা হবে না। তবে এ মুহূর্তে আমাদের ৫৫ মিলিয়ন ডলার দরকার। সূত্র মতে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সার আমদানির ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।