দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা, গবেষণার পরিবেশ, গবেষণার মান, ইন্ডাস্ট্রি সংযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং করা হয়। কিন্তু এসব মানদণ্ডে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক পিছিয়ে। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড় শতাধিক। বিশ্ব বা এশিয়া র্যাংকিংয়েও ভালো অবস্থানে নেই এসব বিশ্ববিদ্যালয়। গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং-২০২৫-এর তালিকার সেরা ৮০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পায়নি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া এশিয়ার সেরা ৩০০টির তালিকায়ও নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক ও গুণগত গবেষণা ও প্রকাশনা পর্যাপ্ত না থাকায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে রয়েছে বলে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক মান ও মূল্যায়নের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্থা প্রতিবছর র্যাংকিং প্রকাশ করে। এ র্যাংকিং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচিত করে তোলে। এটি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি মূল্যবান হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। এছাড়া র্যাংকিংয়ের শ্রেষ্ঠত্ব; বিভিন্ন দেশের শীর্ষ মেধাবী ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মেধার ভিত্তিতে না দিয়ে দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত ও শিক্ষার পরিবেশ রক্ষা করা হয় না। আন্তর্জাতিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে না পারা এবং গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বাজেটের অভাবসহ নানা কারণে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে স্থান নেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ যুগান্তরকে বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকার বেশকিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে র্যাংকিংয়ের মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো ঠিকমতো উপস্থাপন না করা, গবেষণায় গুরুত্ব কম দেওয়া এবং যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়াসহ নানাবিধ কারণ রয়েছে। তবে দ্রুত আমরা এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছি। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে মেধাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের গবেষণায় জোর দিতে হবে। তাদের পাবলিকেশনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি গরিব ও অসহায় শিক্ষার্থীদের পাবলিকেশন ও গবেষণায় আগ্রহ বাড়াতে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও সরকারের সহায়তার জন্য ইউজিসি কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল, তা দীর্ঘদিন ব্যর্থ হয়েছে। বিগত দিনে যারা উপাচার্য ছিলেন, তারা গবেষণায় নয়, অবকাঠামো উন্নয়ন ও রাজনীতিতে বেশি মনোযোগী ছিলেন। বিগত দিনে মেধাকে গুরত্ব না দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কারণে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা ও যোগ্য শিক্ষার্থী তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া সরকার শিক্ষা খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ দেয়নি। এখন সেটি বাড়াতে হবে। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে যাবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম মূলত গবেষণার ওপর নির্ভর করে। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে প্রথমদিকে অবস্থান করতে হলে শিক্ষার পরিবেশ, পাবলিকেশন ও গবেষণাসহ অনেক বিষয়ের ওপর গুরত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো উপস্থাপন করতে হবে। এবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র্যাংকিংয়ে স্থান পেয়েছে। সামনে আরও ভালো করার চেষ্টা করব।
তিনি বলেন, বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, গবেষণা বিষয়ে সেরা কাজগুলো বর্তমানে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা করছেন। একইভাবে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাদের মতে বর্তমানে কোন বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে দক্ষ, উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন এবং কার্যকর গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে।
প্রতিবছর যুক্তরাজ্যের টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে। বুধবার ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ২০২৫’ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম র্যাংকিংয়ে ২০২৫ সালের সংস্করণে ১১৫টি দেশ ও অঞ্চলের ২০০০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল্যায়ন করেই তালিকা করা হয়েছে।
এতে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে প্রথম ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। তবে তালিকায় ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে আছে দেশের ৫ বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এ পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। গত বছরের তালিকায় বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে ছিল ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। এবার তারা সেরা ১০০০-এর মধ্যে আসতে পারেনি। তবে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে শেষের দিকে দেশের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। তালিকায় জায়গা পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১৭টি সরাসরি র্যাংকিংয়ে জায়গা পেয়েছে। বাকি সাতটি রিপোর্টার হিসাবে তালিকায় জায়গা পেয়েছে। এবারের তালিকায় দেশসেরা হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে আছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এরপর ৮০১ থেকে ১০০০ এর মধ্যে আছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।
তালিকার ১০০১ থেকে ১২০০-এর মধ্যে থাকা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, চুয়েট, কুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ১২০১-১৫০০-এর তালিকায় আছে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এবারের র্যাংকিংয়ে শীর্ষে আছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় স্থানে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এবং তৃতীয় স্থানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
এদিকে চলতি বছর ৩০ এপ্রিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে এশিয়ার ৩১ দেশের ৭৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এ র্যাংকিং করা হয়েছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সেরা ৩০০ তালিকায় ভারতের ৪০টি, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। দেশের মধ্যে বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৩০১-৩৫০-এর মধ্যে। এছাড়া ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৪০১-৫০০ এর মধ্যে এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৫০১-৬০০ এর মধ্যে।
র্যাংকিংয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম চীনের জিংহুয়া ইউনিভার্সিটি, দ্বিতীয় চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি, তৃতীয় ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর, চতুর্থ সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং পঞ্চম জাপানের ইউনিভার্সিটি অব টোকিও।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল হান্নান যুগান্তরকে বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং অনেকগুলো মানদণ্ডের ভিত্তিতে করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গবেষণা। অথচ দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এখনো পিএইচডির অনুমতি দেওয়া হয়নি। এছাড়া উচ্চশিক্ষার পরিবেশ, গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা, গবেষণার মান, মানবকল্যাণে অবদান, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব বিষয়কে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।