অতিমূল্যের কারণে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের পাত থেকে অনেকটাই উঠে গেছে মাছ ও মাংস। সবজির দামও অসহনীয়। এমন প্রেক্ষাপটে বাড়তি চাপ পড়েছে ডিমের বাজারে। এর সুযোগও নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। খুচরা বাজারে এখন প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়। এ ছাড়া পাইকারি ডিমের বাজার বন্ধ থাকায় মহল্লার দোকানগুলোতে ডিমের সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক দোকানেই মিলছে না ডিম। এমন অবস্থায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভোক্তারা।
গতকাল ঢাকার আগারগাঁও, তালতলা ও শ্যামলী এলাকার বাজার ও মুদি দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, খুচরা বাজারে ডিমের দাম আরও বেড়েছে। গত সপ্তাহে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা ডজন বিক্রি হওয়া ডিম গতকাল বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়। এ ছাড়া সংকটের কারণে অনেক দোকানে ডিম বিক্রি হচ্ছে না। তালতলা ও পশ্চিম কাফরুলের ভূঁইয়া জেনারেল স্টোর, আল-আমিন স্টোর, তপন স্টোর, বিসমিল্লাহ্ স্টোর ও চাঁদপুর স্টোর ঘুরে দেখা যায়, এসব দোকানে ডিম বিক্রি বন্ধ রয়েছে। বন্ধের কারণ জানতে চাইলে এসব দোকানের স্বত্বাধিকারীরা জানান, পাইকারি বিক্রেতারা গত তিন থেকে চার দিন ধরে তাদেরকে ডিম দিয়ে যাচ্ছে না। এজন্য ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন তারা। আল-আমিন স্টোরের স্বত্বাধিকারী মানবজমিনকে বলেন, ৫ দিন আগে আমার ডিম শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে পাইকারি বিক্রেতারা আমার দোকানে ডিম দিয়ে যায়নি। এজন্য ডিম বিক্রি করতে পারছি না। ডিম না পেয়ে অনেকে ঘুরে চলে যাচ্ছেন। এ ছাড়া পাইকারি বিক্রেতারা নির্ধারিত রেট না দেয়ার ফলে ডিম বিক্রি করতে গিয়ে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। ক্রেতারা অনেক ঝামেলা করে। এজন্য আমরাও ডিম বিক্রি করতে বেশি আগ্রহী না।
অন্যদিকে ডিমের দাম বাড়ার তথ্য দিচ্ছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সংস্থাটি রাজধানীর বাজারগুলোতে ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ৫৫টি পণ্যের মূল্য মনিটরিং করে থাকে। টিসিবি’র হিসেবে গেল এক মাসের ব্যবধানে ডিমের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বর্তমান বাজারে খুচরা পর্যায়ের ডিমের দাম প্রতি হালি ৫৮ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতি ডজনের দাম হওয়ার কথা ১৭৪ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত।
এদিকে ডিমের দাম অত্যধিক বাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ভোক্তারা। তালতলার বাসিন্দা আতাউর রহমান বলেন, বাজারে সব পণ্যের দাম অনেক বাড়তি। এর মধ্যে যাও একটু ডিমের দাম কম থাকবে, সেখানে আজকে দাম শুনে এক প্রকার অবাক। ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। প্রতিদিন এভাবে ডিমের দাম বাড়লে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যান্য জিনিসের দামও তো অনেক বেশি। সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন বুঝতে পারছি না। আরেক ক্রেতা রিবন আহমেদ বলেন, আমি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা করছি। আমাদের প্রতিদিনের খাবার তালিকায় ডিম থাকে। কিন্তু এখন খাদ্যতালিকায় ডিম রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অসহনীয় দামের কারণে মাছ ও মাংস তো খেতে পারি না। এমন অবস্থায় ডিমের দামও যদি সহনীয় না থাকে তাহলে আমাদের তো অপুষ্টিতে ভুগতে হবে।
এদিকে এক মাসের বেশি সময় ধরে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে গরিবের আমিষ খ্যাত ডিম। বেশি দামের কারণে যারা মাছ- মাংস কিনতে পারেন না তারা মূলত ডিমের উপর নির্ভর করতেন। এই শ্রেণির ক্রেতারা এখন বিপাকে পড়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ টাস্কফোর্স ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার তদারকি টিম নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। সরকার নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি না করলে জরিমানা করছে এই টিম। এজন্য ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার আড়তদাররা। আড়তদাররা জানান, সরকারি দামে ডিম কিনতে পারছেন না তারা। দেড় মাস ধরে তাদের বেশি দামে ডিম কিনতে হচ্ছে। তবে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে আরও কম। ফলে লোকসান গুনে বিক্রি করতে হচ্ছে। এর ওপর প্রশাসনের অভিযানের কারণে আরও লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই তারা বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন।
রাজধানীতে ডিম বিক্রির অন্যতম বড় পাইকারি বাজার হচ্ছে তেজগাঁও আড়ত। দেশের বিভিন্ন স্থানের খামার থেকে ট্রাকে করে এখানে ডিম আসে। এরপর তেজগাঁও থেকে ঢাকার বিভিন্ন খুচরা বাজার ও পাড়া-মহল্লায় ডিম সরবরাহ হয়। ফলে তেজগাঁওয়ে ডিম বিক্রি বন্ধ রাখলে সাধারণত খুচরা বাজারে তার প্রভাব পড়ে। এই আড়তের মেসার্স সততা এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার হাজী রবিউল আলম বলেন, সরকার আমাদের ১১.১ টাকায় ডিম বিক্রি করতে বলছেন। এই দামে তো আমরাও ডিম কিনতে পারছি না। প্রতিটি ডিম কিনতে খরচ পড়ছে ১৩ টাকা। এজন্য ডিম আনা বন্ধ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, আগে আমরা প্রতিদিন প্রায় এক গাড়ি ডিম আনতাম। এখন সেটা আনতে পারছি না। ডিমের সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা চাহিদা অনুযায়ী ডিম পাচ্ছি না। এ ছাড়া কয়েক দফায় হাত বদলের কারণে ডিমের দাম বৃদ্ধি পায় বলেও জানান ডিমের এই আড়তদার। অন্যদিকে চট্টগ্রামে ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল শুক্কুর লিটন গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বেঁধে দেয়া দামে ডিম ক্রয় ও বিক্রি করা যাচ্ছে না। বলা হয়েছে উৎপাদন পর্যায় থেকে ১০ টাকা ৫৮ পয়সায় ডিম কেনা যাবে। কিন্তু বাস্তবে কিনতে হচ্ছে ১৩ টাকার বেশি দামে। এখন আমরা কীভাবে ১১ টাকায় ডিম বিক্রি করবো?
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসেন বলেন, ডিমের দাম বাড়ানোর বিষয়টিকে ভালোভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্য নিয়ে আগে ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করছে আর এখন আমলারাও এর সঙ্গে জড়িত হয়েছে। যখন সরকার বলছে এগুলো তদারকি করা হবে তখন এক দল পাইকারি বিক্রেতা ও করপোরেট গ্রুপগুলো বিক্রি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়। তারা বিক্রি বন্ধ করে দেয়ার পর থেকে দাম ২০-৩০ টাকা বেড়ে যায়। আমি মনে করি যারা ঘোষণা দিয়ে বন্ধ রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারাই মূলত সিন্ডিকেটকারী।
ডিমের নতুন দাম নির্ধারণ: এদিকে উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মুরগির ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। আজ থেকে নতুন এই মূল্য কার্যকর হবে। গতকাল ডিম উৎপাদক এবং সরবরাহকারীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ আলীম আখতার খান নতুন এই মূল্য নির্ধারণের ঘোষণা দেন। তিনি জানান, উৎপাদক পর্যায়ে ১০ টাকা ৯১ পয়সা, পাইকারিতে ১১ টাকা ১ পয়সা ও খুচরায় ১১ টাকা ৮৭ পয়সায় ডিম বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন মূল্য কার্যকরের পর ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ডজন কিনতে খরচ হবে ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। ভোক্তার ডিজি বলেন, নির্ধারিত দামের চেয়ে যাতে বেশি মূল্যে ডিম বিক্রি না করা হয় সেজন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হবে। তারপরেও বেশি দামে ডিম বিক্রি হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ডিমের দাম বৃদ্ধির কারণ উৎপাদন ও ক্রেতার মাঝে বহু স্তর বা মধ্যস্বত্বভোগীর সংশ্লিষ্টতা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে উৎপাদনকারী, পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা পর্যায় বাদে অন্যান্য স্তরগুলো বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন মোহাম্মদ আলীম আখতার খান।
১৩০ টাকায় প্রতি ডজন ডিম বিক্রি করছে সরকার: সরকারি উদ্যোগে ১৩০ টাকা ডজন ডিম বিক্রি করছে সরকার। গতকাল থেকে রাজধানীর ২০টি স্পটে এই মূল্যে ডিম বিক্রি করা হচ্ছে। স্থানগুলো হচ্ছে সচিবালয় এলাকার খাদ্য ভবন, মানিক মিয়া এভিনিউ, মিরপুর-১০, বাসাবো, বছিলা, রায়ের বাজার, রাজারবাগ, মুগদা উত্তর, মুগদা দক্ষিণ, পলাশী মোড়, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, বেগুনবাড়ী, উত্তর খান, দক্ষিণ খান, কামরাঙ্গীরচর, রামপুরা ও জিগাতলা।
এদিকে ডিমের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজারে ডিমের চাহিদা সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি। বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নেই। ডিম তো আর আমি মেশিন দিয়ে তৈরি করতে পারবো না। বাজারে সরবরাহ নেই, তাই দাম বেড়েছে।
তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেছেন, ডিমের দাম বাড়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। ৭০ শতাংশ দাম ফিডের খরচের ওপর নির্ভর করছে। এই ফিডের দাম তো এই সময়ে বাড়েনি। তাহলে দামটা বাড়লো কেন? বাজারে ডিমের দাম বৃদ্ধির পেছনে কারসাজি রয়েছে। এটিকে অপরাধ হিসেবে দেখা উচিত। উপদেষ্টা বলেন, পত্রিকায় খবর এসেছে, আমদানির কারণে ডিমের দাম কমে গেল। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এখানে একটা কারসাজি আছে। এখানে কোনো একটা পক্ষ সক্রিয়, যারা ডিমের দাম বাড়িয়েছে। তা না হলে কমে কী করে?