চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে নেয়া মেগা প্রকল্পের বিষয়ে নতুন করে মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। যেসব প্রকল্প রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন করবে না অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এমনকি এসব প্রকল্প যাতে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সরকারও বাস্তবায়ন না করে সে সম্পর্কিত সুপারিশ রেখে যেতে পারে সরকার। প্রয়োজন ও সুবিধা বিবেচনায় জাপানি অর্থায়নে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একনেক। এর বাইরে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া বে-টার্মিনাল প্রকল্পটি নিয়ে এখন পর্যালোচনা চলছে। দায়িত্ব নেয়ার পর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করে এসেছেন।
এর মধ্যে বে-টার্মিনাল এলাকাও তিনি পরিদর্শন করেন। মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে কম ব্যয় এবং সরকারি বেসরকারি বে-টার্মিনালগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে পরবর্তী চিন্তা করা হবে। বন্দর সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বে-টার্মিনাল প্রয়োজন হলেও যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তা অনেকটা বিলাসী। গভীর সমুদ্র বন্দর বাস্তবায়ন হলে এই বিশাল এবং বিলাসী প্রকল্পের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু টানেলের উদাহরণ দিয়ে অনেকে বলছেন, এটি একটি বিলাসী প্রকল্প। এই প্রকল্পে এখন প্রতিদিন লোকসান গুনতে হচ্ছে। বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে হওয়ার কথা। প্রকল্প এলাকায় চারটি টার্মিনাল করার পরিকল্পনা রয়েছে। বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনের বিষয়টি যাচাই না করে একসঙ্গে চারটি টার্মিনালের কাজ হাতে নেয়াও যৌক্তিক নয়। সূত্রের দাবি, বিগত সরকারের সুবিধাভোগী কিছু কর্মকর্তা ও পরামর্শক এই প্রকল্প বাস্তবায়নে উৎসাহী ছিলেন। বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সরকারি এবং বেসরকারি জেটিগুলোর প্রায় অর্ধেক অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সেগুলো ব্যবহার না করে বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে বে-টার্মিনাল নির্মাণের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারি ও বেসরকারিভাবে বর্তমানে যে জেটিগুলো কার্যকর ও নির্মাণাধীন আছে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে অর্থনৈতিক এ সংকটের সময় বড় প্রকল্প হাতে নেয়ার প্রয়োজন হবে না। চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন জেটি সংখ্যা ১৭টি, যার মধ্যে ১১টি কনটেইনার জেটি, বাকি ছয়টি বাল্ক কার্গো জেটি। এ ছাড়াও সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত জেটির মধ্যে চালু আছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, ডলফিন ওয়েল জেটি, গ্রেইন সাইলো জেটি, সিমেন্ট ক্লিংকার জেটি, টিএসপি জেটি ও সিইউএফএল জেটি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী ড্রাইডকের দুটি জেটিও চালু আছে। এই প্রকল্পের জন্য বড় ঝুঁকি হলো বিশাল জায়গা জুড়ে দ্রুত পলি পড়ার কারণে যতই ড্রেজিং করা হোক না কেন, দীর্ঘ মেয়াদে নাব্যতা সংকট দূর করা প্রায় অসম্ভব। এই প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে বিভিন্ন সমীক্ষায় এসব তথ্য আসলেও উৎসাহী কর্মকর্তারা তা আমলে নেননি।
সম্প্রতি মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে একনেক। এতে জাপান বিনিয়োগ করবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বিদায়ী সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় কম গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্প নেয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পরই সেগুলো কাটছাঁটের তালিকা তৈরি শুরু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা রাজনৈতিক প্রকল্প বাদ দেয়া হচ্ছে। কমানো হচ্ছে অন্যান্য প্রকল্পের পরিধি। পরিস্থিতি ও বিবেচনায় বে-টার্মিনাল নির্মাণ নিয়েও গভীর পর্যালোচনা হচ্ছে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটির পরিচালক (ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন) মো. আলী আজম আল আজাদ এ বিষয়ে বলেন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের প্রকল্পে সরকারকে কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না। তবে যে কোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে দেশের এবং স্থানীয় অংশীজনের স্বার্থ দেখা হয়ে থাকে। বে-টার্মিনাল নির্মাণ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে নির্দেশনা দেবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা পরিদর্শন করে গেছেন। এই প্রকল্পের অর্থায়ন কারা করবে তাও চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে বন্দর কর্তৃপক্ষ তাই বাস্তবায়ন করবে।