জুলাই বিপ্লব বা আগস্ট বিপ্লব যাই বলুন না ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট খুনি স্বৈরাচার ও এই শতাব্দির নমরুদ-ফেরাউনের প্রেতাত্মা শেখ হাসিনা তার প্রায় সাড়ে ষোল বছরের ময়ূর সিংহাসন ছেড়ে প্রাণ নিয়ে এসএসএফের সহযোগিতায় সশস্ত্র বাহিনীর হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। তার এই পলায়ন দেশের আপামর জনতা আল্লাহর বিশেষ রহমত হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য তৃতীয় স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয়ের অভ্যুদয় হিসেবে গণ্য করছেন। শেখ হাসিনা তার দীর্ঘ সাড়ে ষোল বছরের শাসনামলে দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি থেকে শুরু করে শাসন বিভাগ বা নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা, আইনশৃঙ্খলা, প্রতিরক্ষা ও জননিরাপত্তা, বিচার বিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অপরিহার্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহসহ ব্যাংক, বীমা, অর্থ প্রতিষ্ঠান এবং শিল্প-কারখানাসমূহের মৌলিক ভিত্তি যে শুধু ধ্বংস করে গেছেন তা নয়, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি প্রভৃতির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারও করেছেন। Banking Prudence কে উপেক্ষা করে নিজেদের বাছাই করা ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের ঋণ দেয়ার নামে ব্যাংকসমূহকে তহবিল শূন্য করেছেন। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে অঢেল ঋণ নিয়ে সরকার পরিচালনা করেছেন। ফলে তারল্য সংকটে ব্যাংকগুলো কাস্টমারদের চেক অনার করতে পারছে না আবার বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ চাহিদাও পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থবিরতা দেখা দিয়েছে; নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য মানুষের জীবনকে বিধ্বস্ত করে তুলেছে। এই অবস্থায় দেশের ক্ষতিগ্রস্ত ও বিধ্বস্ত রাষ্ট্রীয় খাতগুলো মেরামত ও সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করেছেন। সংবিধান সংস্কার/পুনর্লেখনসহ কমিশনগুলো বাস্তবতা ও আগামী দিনের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও ফ্যাসিবাদ রোধ কল্পে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে তাদের কাজ শুরু করেছেন এবং আশা করা যাচ্ছে যে, তিন মাসের মধ্যেই এই কাজগুলো সম্পন্ন হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স আজ দুই মাস ৮ দিন হয়েছে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারের ও অন্যান্য বাহিনীর সহযোগিতায় এই সরকার ভয়াবহ একটি পরিস্থিতিতে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছেন। এই সরকার অন্য কোনো সরকারের ধারাবাহিক কোনো সরকার নয়, শেখ হাসিনার সাথে তার কেবিনেটের সকল সদস্য, বিনাভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সমগ্র পুলিশ বাহিনী, ব্যাংক-বীমা কোম্পানিসমূহের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, সিনিয়র আমলা যা তার দুঃশাসনের সহযোগী ছিলেন সবাই পালিয়ে গেছেন। বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি, দুর্নীতিবাজ আমলা ও বিচারক সকলেই ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বাজার ব্যবস্থা সবই ভেঙে পড়েছে। এরপর আসলো প্রথমে বৃহত্তর নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের অংশ বিশেষে প্রলয়ঙ্করী বন্যা। পরে উত্তরাঞ্চলে ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলাসমূহে স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ বন্যা। আমন ও শাকসবজির চাষাবাদের নিশানাগুলো নষ্ট হয়ে গেল। দেশের যখন এই দুরাবস্থা তখন আমাদের একশ্রেণির রাজনীতিক সংস্কার বা শাসনব্যবস্থার পুনর্গঠনকে গৌণ বিবেচনা করে তাৎক্ষণিক ক্ষমতায় যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ দিয়ে পারলে কালকেই যেন তারা নির্বাচনে চলে যেতে চান। সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে এ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। আবার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনাকে গদিচ্যুত করে দেশ ছাড়া করার কৃতিত্বের দাবি নিয়েও প্রচণ্ড বিতণ্ডা শুরু হয়েছে। এ যেন জ¦লন্ত রোমকে সামনে রেখে নিরোর বাঁশি বাজানোর মহরত। রাজনৈতিক শিষ্টাচার আগে অভিধানে আশ্রয় নিয়েছিল, এখন বেচারা একেবারে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। এই সুযোগে পতিত স্বৈরাচার ও তার দোসররা বিজয়ীর বেশে পুনরায় ফিরে আসার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি দুটিই সম্পন্ন করতে শুরু করেছে। তাদের জনবল, অর্থবল ও অস্ত্রবল কোনোটির ওপরই আমরা আঘাত হানতে পারিনি।
এখন জাতীয় নির্বাচনের প্রশ্নে আসি।
কিছু কিছু রাজনৈতিক দল অবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। কেউ কেউ আবার অন্যথায় পুনরায় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকারকে হটানোর হুমকিও দিয়েছেন। জামায়াতের তরফ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করে আনুপাতিক নির্বাচনসহ ৪১ দফা রোড ম্যাপের প্রস্তাব ঘোষণা করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক নির্বাচনের দাবি যারা করেন তাদের আমি বুদ্ধিহীন মনে করি না, তাদের ধারণা নির্বাচন যত তাড়াতাড়ি হবে তাদের ক্ষমতায় যাবার শতভাগ নিশ্চয়তাও তত বাড়বে। আসলে কি তাই? গত দু’দশক ধরে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে তাদের পছন্দমতো সাজিয়ে গেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের পদগুলো সাংবিধানিক পদ। সরকার তাদের নিয়োগ দিতে পারেন, বরখাস্ত করতে পারেন না। দেশের চাহিদা অনুযায়ী তারা ইস্তফা দিতে পারেন। কিছু দিন আগে তারা ইস্তফা দিয়েছেন। নতুন কমিশন নিয়োগের পর তারা নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজ শুরু করবেন। নির্বাচন করতে হলে ভোটার তালিকা দরকার। গত তিনটি নির্বাচনে ভোটারের দরকার হয়নি। ২০০৭ সালে যে নির্বাচন হবার কথা ছিল তখন বলা হয়েছিল যে, সারা দেশের সামগ্রিক ভোটার তালিকায় ৮৬ লক্ষ ভোটার ভুয়া, মৃত অথবা ঠিকানাচ্যুত। এই বিশাল সময়ের ব্যবধানে অনেক লোক মারা গেছেন, শিশুরা ভোটার হবার যোগ্য বয়সে পৌঁছেছে, বিদেশে আমাদের প্রায় এক কোটি প্রবাসী কর্মীরা ভোটার হওয়ার অপেক্ষায়। এমতাবস্থায় নতুন করে ভোটার তালিকা তৈরি (দেশে বিদেশে) করা ছাড়া একটি নির্ভুল নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। এরপর আছে নির্বাচনী এলাকা পুনঃনির্ধারণ ও সম্ভাব্য আপত্তির ভিত্তিতে নিষ্পত্তিকরণ। আওয়ামী লীগ তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়োজনে সীমান্তবর্তী এলাকায় বহু ভারতীয় নাগরিককে ভোটার তালিকাভুক্ত করেছে। দেশের অভ্যন্তরেও যুবলীগ/ছাত্রলীগ দিয়ে ভোটার হালনাগাদ করার নামে যোগ্য বিরোধীদলীয় ছেলেমেয়েদের ভোটার করেনি, ছাত্রলীগের নামে নাবালক ছেলেমেয়েদের ভোটার করেছে। এগুলোর সংশোধন করা দরকার। দেশে ভোটার আইডি কার্ড করা হয়েছিল ভোট দেয়ার জন্য। কিন্তু তা আজো ব্যবহৃত হয়নি। অবিলম্বে ভোট দানের কাজে ব্যবহার করা দরকার। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনী এলাকা, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, কেন্দ্র নির্ধারণ, নির্বাচনী কর্মকর্তা বিশেষ করে রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার নিয়োগ অপরিহার্য। সকল কলেজ, মাদরাসার শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তারা এসব পদে নিয়োগ পেতেন। গত ২০ বছরে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের অনেকেই অবসরে গেছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন। নতুন যারা এসেছেন তারা আওয়ামী লীগেরই লোক। তাদের ব্যাপারে মন্ত্রী-এমপিরাই ঘোষণা করেছেন। এদের পরিবর্তন না করে বা এক্ষেত্রে সংস্কার না এনে নিরপেক্ষ নির্বাচন কি সম্ভব? আর ভোটার তালিকা? দাবি তোলার আগে আপনার নিজ এলাকার ভোটার তালিকা সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাই করে দেখুন। চাকরিজীবীরা অথবা যারা ভাড়া বাড়িতে থাকেন তাদের ঠিকানা বদলায়। তাদের পছন্দের ঠিকানায় ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করা সময় সাপেক্ষ। আবার অনেকে গ্রামে এবং শহরে ভোটার আছেন কিনা তাও পরীক্ষা সাপেক্ষ। এই কাজগুলো কত সময়ে করা যায় হিসাব করুন এবং ঐভাবে তারিখ, নির্বাচনের পরামর্শ দিন।
এখন নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে আসি। সংবিধানে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল করতঃ আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার সুপারিশ জামায়াত থেকে এসেছে। সহযোগী একটি দৈনিক ও কিছু কিছু রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করেছেন। অনেকগুলো দেশে এই প্রথা চালু আছে। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাই।
অনেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার দল রিপাবলিকান পার্টির আচরণকে অপ্রত্যাশিত ও অভূতপূর্ব বলে উল্লেখ করেছেন। ট্রাম্প নির্বাচনী রায়কে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সন্ত্রাস, সংঘর্ষ ও সংঘাতের মাধ্যমে এই রায়কে উল্টিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১২২২ জন প্রার্থী সে দেশের ফেডারেল নির্বাচন কমিশনে আবেদনপত্র পেশ করেছিলেন। তাদের মধ্য থেকে সম্ভাবনাময় দু’জন প্রার্থী রিপাবলিকান দলের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জোসেফ বাইডেনকে কমিশন প্রার্থী হিসেবে গ্রহণ করে।
উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। তবে এখানে জনগণের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয় না। জনগণ ভোট দিয়ে একটি নির্বাচনী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যে প্রার্থী নির্বাচনী কলেজে বেশি ভোট পান তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু সব সময় যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি পপুলার ভোট পান সে প্রার্থী নির্বাচনী কলেজে সবচেয়ে বেশি ভোট নাও পেতে পারেন।
২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প মোট পপুলার ভোট পেয়েছিলেন ৬,২৯,৭৯,৬৩৬ যা হিলারী ক্লিনটন থেকে ২৮,৬৪,৯৭৪ ভোট কম ছিল। পপুলার ভোটে হেরে গেলেও নির্বাচনী কলেজ ভোটে ট্রাম্প জয়ী হয়েছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন ৩০৬ ভোট, পক্ষান্তরে হিলারী পেয়েছিলেন ২৩২ ভোট। অনুরূপভাবে জর্জ বুশ ২০০০ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী আল গোরকে নির্বাচনী কলেজ ভোটে পরাজিত করেন। ১৮২৪ সালের নির্বাচনে জন কুইন্স এডামস্্ জনগণের ভোটে এন্ড্রু জেকশনের কাছে ৩৮ হাজার বেশি ভোটে হেরে যান কিন্তু নির্বাচনী কলেজ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৮৭৬ এবং ১৮৮৮ সালের নির্বাচনেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে।
বর্তমান নির্বাচনে শুধু নির্বাচনী কলেজ ভোটেই ডোনাল্ড ট্রাম্প হারেননি, তিনি পপুলার ভোটেও হেরেছেন। ট্রাম্প পপুলার ভোট পেয়েছেন ৭,৪২,২২,৫৯৩টি অন্যদিকে বিজয়ী প্রার্থী জো বাইডেন পেয়েছেন ৮,১২,৮১,৫০২ ভোট। অর্থাৎ ৭০,৫৯,০০৯ ভোট বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ভোটের প্রতিনিধিত্ব সম্পন্ন নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু আছে। আমাদের দেশেও এ ধরনের ব্যবস্থা প্রচলিত। বক্ষমান আলোচনায় আমি এ ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার সুফল নিয়ে কিছু আলোচনা করবো এবং আমাদের দেশে এ ব্যবস্থা প্রচলনের সম্ভাব্যতা নিয়ে আরও আলোচনার আহ্বান জানাবো।
যত দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয় সব দেশেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সংগঠক, ইসলামী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মরহুম অধ্যাপক গোলাম আজম দুটি নির্বাচন পদ্ধতির সুপারিশ করেছিলেন। তার প্রথম পদ্ধতি ছিল কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি যা বাংলাদেশ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে এ পদ্ধতির ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটি মজবুত ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে এই পদ্ধতিটি বাতিল করে দেয়।
এর ফলে বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা পুনরায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং তা টাকার দাপট ও সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে দাঁড়ায়। ফলে জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ না পেয়ে নির্বাচনের উপর থেকেই তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, যে দলই ক্ষমতায় থাকে সেই দলই সরকারি ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে নিজেদের দলীয় প্রার্থীকে অন্যায়ভাবে বিজয়ী করার নানা অপচেষ্টা চালায়। ক্ষমতাসীন সরকারদলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করে এবং তারা দলীয় সরকারের সমর্থক দেখে দেখে রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার নিয়োগ করে যারা সরকারি কারচুপিকে ত্বরান্বিত করে। ভোট প্রার্থীরা বিভিন্নভাবে জাল ভোট সংগ্রহ করে বিজয়ী হবার অপচেষ্টা চালায়। তারা সন্ত্রাসী জনবল ব্যবহার করে ভোট কেন্দ্র দখল করে এবং ব্যালট বাক্সে জাল ভোট ঢুকায়।
ভোটারদের আইডেনটিটি কার্ড না থাকলে এবং থাকলেও ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা না থাকায় আসল ভোটারের নামে নকল ভোটার ভোট চুরি করার সুযোগ পায়। ভোটপ্রার্থী বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করে বিজয়ী হবার উদ্দেশ্যে গরিব ভোটারদের টাকার বিনিময়ে ভোট দিতে প্রলুব্ধ করে। আবার সন্ত্রাসীরাও এ ব্যাপারে বিপুল অংকের ঠিকাদারী নেয়। প্রার্থীরা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে প্রচারাভিযান চালিয়ে সাধারণ ভোটারদের ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেয়। তাদের প্রচারাভিযানে প্রভাবিত হয়ে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী বিজয়ী হবার সম্ভাবনা আছে মনে করে এক শ্রেণীর ভোটার তাকে ভোট দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের জন্য এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পার হলেও এই দেশটি এখনও পর্যন্ত একটি স্বীকৃত নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আশি ও নব্বই-এর দশকে সবগুলো প্রধান রাজনৈতিক দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি, আওয়ামী লীগ, এরশাদের জাতীয় পার্টির স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্দলীয় নিরেপক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে একমত হলেও চারটি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই ব্যবস্থা বাতিল করে নিন্দিত স্বৈরাচারী দল জাতীয় পার্টি ও বামপন্থীদের সাথে জোট করে গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করে দেশবাসীকে নিদারুণ হতাশার মধ্যে নিক্ষেপ করে।
তারা এতই ত্যাক্ত বিরক্ত যে তারা গত স্বৈরাচারী আমলে নির্বাচনের নামই শুনতে চাইত না। ফলে দেশ রাজনীতিহীন হয়ে পড়ে। মানুষের ওপর স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসে, মানুষ অধিকারবিহীন, তার জানমাল ইজ্জত কোন কিছুরই নিরাপত্তা ছিল না। এই অবস্থায় দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ ফিরিয়ে আনা অত্যাবশ্যক।
বলাবাহুল্য, বর্তমান বিশ্বে নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রধানত দুই ধরনের প্রতিনিধিত্ব দেখা যায়। এক ধরনের প্রতিনিধিত্ব সবচেয়ে বেশি ভোটের প্রতিনিধিত্ব (Plurality Rule) নামে পরিচিত যা বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। দ্বিতীয় ব্যবস্থা হলো আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব। আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব হলে জয় শুধু একজন প্রার্থীরই হয় না, জয়ের ফলাফল ভোট প্রাপ্তির আনুপাতিক হারে বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। যদি জাতীয়ভাবে অনুপাত নির্ধারণ করা হয় তাহলে যে দল নির্বাচনে যে পরিমাণ ভোট পাবে সেই হারে সে দল সংসদে আসন পাবে। উদাহরণস্বরূপ ২০১৪ সালের ভারতের নির্বাচনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ভারতের প্রতিটি নির্বাচনী কেন্দ্রে যে সর্বোচ্চ ভোট পায় সে নির্বাচিত হয়। এর ফলে এই নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে ৫১.৯ শতাংশ সংসদীয় আসন পাওয়া সম্ভব হয়েছে। যদি আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব নির্ধারিত হতো তাহলে ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজেপি ৩১ শতাংশ সংসদীয় আসন পেত অন্যান্য দল ২৫.৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৪.৬ শতাংশ সংসদীয় আসনের পরিবর্তে ২৫.৭ শতাংশ আসনই পেত। এ প্রেক্ষিতে আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে ভোটারদের ইচ্ছা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়।
বিশ্বের বহু দেশে বিশেষ করে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, ইজরাইল এবং জার্মানীতে আংশিকভাবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু আছে। অধ্যাপক আজম এই ব্যবস্থার কতিপয় সুফলের বর্ণনা দিয়েছেন।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতি অবলম্বন করলে রাজনীতিতে বিরাট গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে। এক্ষেত্রে সকল রাজনৈতিক দল জনসমর্থন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে দেশ গড়ায় পরিকল্পনা রচনার প্রতিযোগিতায় লেগে যাবেন। কোন নেতা বা নেত্রীকে দলের একমাত্র পুঁজি হিসেবে তুলে ধরার পরিবর্তে সকল দল দেশকে সবদিক থেকে উন্নত করার জন্য জনগণের নিকট বাস্তব কর্মসূচি নিয়ে হাজির হতে বাধ্য হবে।
রাজনীতির ময়দানে জ্ঞানীগুণী নীতিবান নিঃস্বার্থ চিন্তাশীল মেধাবী ও চরিত্রবান ব্যক্তিগণ এগিয়ে আসবেন। রাজনৈতিক দলে জ্ঞানীগুণীদের কদর বাড়বে। ধনবল ও জনবলের ভিত্তিতে নমিনেশন দেয়ার কুপ্রথা দূর হবে। সংসদে প্রতিভাবান লোকদের সমাবেশ ঘটাবার জন্য রাজনৈতিক দলে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে।
জনগণের প্রতিনিধি হবার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও যারা রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে গণ্য করে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এলাকায় অর্থলগ্নি করতে যাকে এবং একদল মাস্তানকে নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে গড়ে তুলতে এমপি হবার সাধনায় লিপ্ত হয় তাদের উৎপাত সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে।
দলকে ভোট দেয়ার পদ্ধতি চালু হলে কোন ভোটারের ভোটই অর্থহীন হয় না। এক্ষেত্রে সকল দলেরই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়।
প্রচলিত পদ্ধতিতে কোন দল প্রচুর ভোট পাওয়া সত্ত্বেও ভোট সংখ্যার তুলনায় আসন অনেক কম পেতে পারে। ২০০১ সালের নির্বাচনে প্রায় ১৯৮ আসনে বিজয়ী বিএনপির কাছাকাছি ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ মাত্র ৫৯টি সংসদীয় আসনে জয়ী হয়েছিল।
তাদের প্রার্থীরা প্রচুর ভোট পেয়েও অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরেছে। দলকে ভোট দিলে প্রতি দল প্রাপ্ত মোট ভোট সংখ্যার অনুপাতে আসন লাভ করবে এবং ভোটারদের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। ব্যক্তিকে ভোট দিলে কিছু সংখ্যক ভোটার মনে করে যে, যার বিজয়ী হবার আশা তাকে ভোট দেয়াই ভাল যাতে আমার ভোটটা পচে না যায়। দলকে ভোট দিলে কারুর ভোটই পচার আশংকা থাকে না।
আনুপাতিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ময়দানে দলীয় আদর্শ ও কর্মসূচির প্রতিযোগিতা চলবে। রাজনৈতিক দল জনগণকে আঞ্চলিকতা, গোষ্ঠীপ্রীতি ও ব্যক্তি পূজার পরিবর্তে দলীয় আদর্শের দিকে আহ্বান জানাবে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে প্রতিযোগিতার সুযোগ না থাকায় পারস্পরিক বিদ্বেষ, অশালীন সমালোচনা ও সংঘর্ষের কোনও আশংকা থাকবে না। এতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ উন্নত হবে। দেশের বিজ্ঞ রাজনীতিকরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন।