সারা দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছেই। এখন বছর জুড়ে ডেঙ্গু জ্বরের শঙ্কায় ভুগছে মানুষ। বর্তমানে রাজধানীর বড় বড় হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী আসছে বেশি। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। সারা বছর মশানিধনে কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২১৫ জন মারা গেছেন ডেঙ্গুতে। এ মাসের দুই সপ্তাহে ৫২ জন মারা গেছেন ডেঙ্গু জ্বরে। সেপ্টেম্বরে এবছরে সর্বোচ্চ ৮০ জন মারা যান এই রোগটিতে। এর মধ্যে ঢাকার দক্ষিণ সিটিতে সর্বাধিক ১১৪ জন রয়েছেন মৃত্যুর তালিকায়। আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৪৪ হাজার রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু আক্রান্তে পুরুষরা বেশি হলেও মৃত্যুতে নারীরা বেশি। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুতে নারীরা আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হলে হাসপাতালে দেরিতে যান। ঢাকার হাসপাতালগুলোর কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যারা এখন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই ঢাকার বাসিন্দা। তবে ২৫-৩০ শতাংশ রোগী ঢাকার বাইরে থেকে আসছেন।
সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়ানোর কারণ কী জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার মানবজমিনকে বলেন, দেশব্যাপী সারা বছর ডেঙ্গু রোগী থাকার বিষয়টি বড়ই চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়ানোর কারণ হলো- ডেঙ্গু রোগীরা মাইগ্রেট বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করছে। এ ছাড়া সারা দেশে এখন বছর জুড়ে বাড়িঘর নির্মাণ হয়। এজন্য ওইসব জায়গায় পানি জমে থাকার কারণে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে। তিনি আরও বলেন, এ বছরের শুরু থেকে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা করা হয়েছিল। আমি আগেই বলেছি- সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে। তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় প্রশাসন এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সারা বছর মশা নিধনে আমাদের কাজ করতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। কবে নাগাদ ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে এলে এক মাসের মধ্যেই সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে এ মুহূর্তে ডেঙ্গুর হটস্পট নির্ধারণ করে সঠিক ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেন তিনি।
এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও একজন মারা গেছেন। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৫ জনে। একদিনে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও ১১৮৬ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৬৫৬ জনে। চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি থেকে ১৪ই অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ৪৩ হাজার ৬৫৬ জন। যাদের মধ্যে ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত মৃত ২১৫ জনের মধ্যে ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ পুরুষ এবং ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ নারী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, এ পর্যন্ত বিভাগ অনুযায়ী বরিশাল বিভাগে আক্রান্ত ৩ হাজার ৭৮৩ জন (মৃত্যু ২৫ জন), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে আক্রান্ত ৪৫ জন (মৃত্যু ১ জন), চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি ব্যতীত) ৮ হাজার ৩৬৭ জন (মৃত্যু ২২ জন), ঢাকা বিভাগে ৬ হাজার ৬০৩ জন (মৃত্যু ৭ জন), ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আক্রান্ত ৯ হাজার ৩৬৩ জন (মৃত্যু ১১৪ জন), ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনে ৮ হাজার ৯৮৮ জন (মৃত্যু ৩১ জন), গাজীপুরে আক্রান্ত ৩ জন, খুলনায় ৩ হাজার ৫২৫ জন (মৃত্যু ১২ জন), ময়মনসিংহ বিভাগে ১ হাজার ১৪৬ জন আক্রান্ত (মৃত্যু ২ জন), রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ৮০ জন (মৃত্যু ১ জন), রংপুর বিভাগে ৬৬৪ জন এবং সিলেট বিভাগে ৮৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বয়সভিত্তিক মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শূন্য থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৮৯ জন মারা গেছেন। শূন্য থেকে ২০ বছরের মধ্যে মারা গেছেন ৪০ জন। ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সী মৃত্যু ২৪ জন। এরপরে রয়েছে ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী সর্বোচ্চ ২৫ জন রয়েছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৫৫ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৪ জন। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ৩৩৯, মৃত্যু ৩ জন। মার্চে আক্রান্ত ৩১১, মৃত্যু ৫ জন। এপ্রিলে আক্রান্ত ৫০৪, মৃত্যু ২ জন। মে মাসে আক্রান্ত ৬৪৪ জন এবং মারা গেছেন ১২ জন। জুনে আক্রান্ত ৭৯৮ এবং মৃত্যু ৮ জন। জুলাইয়ে আক্রান্ত ২ হাজার ৬৬৯ জন, মৃত্যু ১২ জন। আগস্টে আক্রান্ত ৬ হাজার ৫২১ জন এবং মারা গেছেন ২৭ জন। চলতি সেপ্টেম্বরে চলতি বছরের রেকর্ড পরিমাণ আক্রান্ত ১৮ হাজার ৯৭ জন এবং মারা গেছেন ৮০ জন। অক্টোবরে ১৪ দিনে আক্রান্ত ১২ হাজার ৭১৭ জন এবং মারা গেছেন ৫২ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয় মূলত বর্ষাকালে। আগস্ট থেকে বাড়তে থাকে এর ভয়াবহতা। কিন্তু চলতি বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি শুরু হয়। এতে এডিস মশারা তাদের প্রজননে উপযুক্ত আবহাওয়া পেয়ে গেছে বর্ষার আগেই। এখনো এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে ডেঙ্গুর প্রজননস্থল ধ্বংসে ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন তারা। একইসঙ্গে আবহাওয়ার তারতম্যও সমানভাবে দায়ী করেন তারা।