দেশে ডলার সরবরাহ বাড়লেও এলসি খুলতে পারছে না বেশ কিছু ব্যাংক। তাদের গ্যারান্টি দিচ্ছে না বিদেশি ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সরকার পরিবর্তনের পর বেশির ভাগ ব্যাংকই এলসি বিড়ম্বনায় পড়েছিল। এখন সেই সমস্যা কেটে গেছে।
দেশে ডলার সরবরাহও বেড়েছে, আবার রাজনৈতিক অস্থিরতাও কমে এসেছে; কিন্তু যেসব ব্যাংক তাদের আগের আমদানি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে তাদের নতুন করে এলসি খোলার জন্য গ্যারান্টি দিচ্ছে না বিদেশি গ্যারান্টাররা। এতে সমস্যায় পড়েছে ব্যাংকগুলো।
এস আলমের হাত থেকে মুক্ত একটি দুর্বল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর আমরা খুবই সমস্যায় পড়েছিলাম। এলসিই করতে পারছিলাম না।
আবার আগের দায়ও পরিশোধ করতে পারছিলাম না। এখন রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে দেশে ডলার সরবরাহ বেড়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আমাদের এলসি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। সীমিত আকারে হলেও এখন আমরা এলসি খুলতে পারছি, কিন্তু যাদের পেমেন্ট বকেয়া রয়েছে সেসব ব্যাংক একটু সমস্যায় রয়েছে।
’
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ নির্বাহী জানান, কয়েক দিন আগে একজন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে তিনি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সময়মতো তাঁদের দেশের উৎপাদকদের অর্থ পরিশোধ করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন। এটা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির বিষয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁদের কথা দিয়েছে যেসব ব্যাংকের ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে তাদের কাছ থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করা হবে। পাশাপাশি খুব শিগগির তাদের পেমেন্ট নিশ্চিত করা হবে।
তবে রিজার্ভ থেকে আর কোনো ডলার ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছেন তিনি।
‘কান্ট্রি রেটিং’ খারাপ হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত না হওয়ায় দেশের ব্যাংকগুলোকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোর গ্যারান্টির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের এলসির গ্যারান্টির বড় অংশই দেয় মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাংকগুলো। ভারত ও ইউরোপ-আমেরিকার বৃহৎ ব্যাংকগুলোও কিছু এলসির গ্যারান্টার হয়। এ জন্য বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য একটি ঋণসীমা অনুমোদিত থাকে।
ডলার সংকটের কারণে দুই বছর ধরেই বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর জন্য তাদের ঋণসীমা কমিয়ে এনেছে। সম্প্রতি পরিস্থিতি আরো বেশি নাজুক হয়েছে। ১১টি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া, তারল্যসংকট এবং নানা নেতিবাচক প্রচারণার কারণে বিদেশি অনেক ব্যাংকই বাংলাদেশের কিছু ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না। যে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা বেশ ভালো তাদের জন্যও ঋণসীমা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এলসি খোলার জন্য দেশের ব্যাংকগুলোকে বাড়তি কমিশন বা ফিও গুনতে হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
‘থার্ড পার্টি গ্যারান্টি’ হিসেবে আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক মাশরেক ব্যাংকের সঙ্গে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী এই ব্যাংক বাংলাদেশের বেশির ভাগ ব্যাংকেরই এলসির গ্যারান্টার হয়। রাজনীতির পাশাপাশি ব্যাংক খাতের অস্থিরতার কারণে ব্যাংকটি দেশের অনেক ব্যাংকেরই ঋণসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। ভারত, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু ব্যাংক ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে বলে ব্যাংক নির্বাহীরা জানিয়েছেন। ইউরোপের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা রয়েছে জার্মানির কমার্স ব্যাংকের। এই ব্যাংকও দেশের কিছু ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না।
দেশের ডলারপ্রবাহ ও বৈদেশিক বাণিজ্য পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় ‘ব্যালান্স অব পেমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে, যা বিওপি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা বিওপির সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের ডলারপ্রবাহ ও বৈদেশিক বাণিজ্য পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে দেশের আমদানি ব্যয় ছিল এক হাজার তিন কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এ ব্যয় ৯৯১ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে আমদানি ব্যয় কমেছে ১.২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে আমদানির এলসি খোলা ১২.৯৬ শতাংশ কমে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৪৩.৭১ শতাংশ কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। আর আগস্ট পর্যন্ত প্রথম দুই মাসে আমদানির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৩ শতাংশেরও বেশি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান গতকাল জানান, ১২০ থেকে ১২১ টাকার মধ্যে ডলার লেনদেন হয়েছে ব্যাংকে। সরবরাহের দিক থেকে পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। তবে গ্যারান্টাররা কিছু কিছু ব্যাংকে সমস্যা করছে। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও মাশরেক ব্যাংক সবচেয়ে বেশি গ্যারান্টি দিয়ে থাকে; কিন্তু দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ব্যাংকিং সংস্কারে তাদের মধ্যে কিছুটা অনীহা দেখা যাচ্ছে। তবে সেই অনীহা সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে নয়।
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/10/15/1435241