সৌদি আরবের পর বাংলাদেশের জন্য বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। দেশটি বর্তমানে রেমিটেন্স আরোহনের দিক থেকে অষ্টম থেকে চতুর্থ অবস্থানে এসেছে। অথচ অসাধু চক্র মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ধ্বংস করার মিশনে নেমেছে। তারা বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মালয়েশিয়ার জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়র নির্দেশের পরও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে শ্রমিক সংকটের জন্য দায়ী প্রায় ১১শ’ সহযোগী এজেন্সির বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় বলছে সংশ্লিষ্টদের গাফেলতিসহ নানা কারণে গত মে মাসে মালয়েশিয়ায় যেতে পারেনি প্রায় ১৭ হাজার শ্রমিক। তাদেরকে নতুন করে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব শ্রমিকের তালিকা তৈরি বা প্রকাশ করা হয়নি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ মে মালয়েশিয়ান সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে অনুমতি পাওয়া ১৬ হাজার ৯৭০ জন কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। কর্মীপ্রতি কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা হিসেবে ৮৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা আটকে আছে। অর্থ ফেরতের জন্য দুই দফা সময় বেঁধে দেওয়া হলেও অনেক শ্রমিক তাদের অর্থ বুঝে পাননি। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সভাপিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিরণী থেকে জানা গেছে, মালয়েশিয়া যেতে না পারা কর্মীদের সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ১০১ টি রিক্রুটিং এজেন্সি সরাসরি শ্রমিকদের কাছ থেকে অর্থ না নিয়ে সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির নিকট থেকে অর্থ নিয়েছে। অর্থ ফেরত প্রক্রিয়ায় সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে সম্পৃক্ত করা না গেলে শ্রমিকদের অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মালয়েশিয়া যেতে না পারা শ্রমিকদের দায়-দেনা পরিশোধপূর্বক প্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট ১০১টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে অবহিত করবে।
এছাড়া গত ২৬ সেপ্টেম্বর বহির্গমণ ছাড়পত্র পাওয়া কর্মীদের দায় দেনা পরিষদের তথ্য ১০ অক্টোবরের মধ্যে নির্ধারিত ছকে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে জানান, অসাধু চক্রের অপতৎপরতার কারণে মালশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে। সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো শুধু একটা টিকেট কেটে শ্রমিকদের কাছ থেকে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা নিয়েছে। অথচ তারা আইনের আওতায় আসছে না। মন্ত্রণালয়ের নজরে আসছে না। একদিকে তারা বলছে, ৬ লাখ টাকা করে শ্রমিক গিয়েছে আবার বলতেছে তারা দেড় লাখ টাকা একশ’ এক রিক্রুটিং এজেন্সিভুক্তদের দিয়েছে। অনুমোদিত এজেন্সিগুলো ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মধ্যে এলোকেশন, জব, ডিমান্ড লেটার, সত্যায়ণ, ভিসা করানো, বিটিএমইএর ক্লিয়ারেন্স, নিয়োগানুমতি ও বর্হিগমনসহ যাবতীয় আনুসঙ্গিক কাজ সম্পাদন করেছে। আর সহযোগী এজেন্সিরা ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার একটি টিকেট করে সাড়ে ৪ লাখ টাকা করে নিয়েছে। এসব তথ্য গোপন রেখে তারা নানা অপ্রচার করছে।
কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ বাণিজ্যে ১০ সিন্ডিকেটের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগীদের একজন ছিলেন বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফকরুল ইসলাম। তিনি মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা বানিজ্যের জন্য বাগিয়ে নিয়েছিলেন নিজের মেডিকেল সেন্টার ওয়েলকাম মেডিকেল। প্রায় ৭০হাজার কর্মীর নাম মাত্র স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। পরিচয় লুকিয়ে কমপক্ষে দুইটি লাইসেন্স রয়েছে একশ’ এক রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকায়। সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকাতেও রয়েছে তার এজেন্সি। সাথে আছে নিজস্ব মেডিকেল সেন্টার ওয়েলকাম মেডিকেল। গত ৩১ মে শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর তিনিসহ আরো কয়েকজন মিলে আবার চেষ্টা করছেন মালয়েশিয়ায় ভিন্ন ফর্মুলায় লোক পাঠানোর শক্তিশালী সিন্ডিকেট গঠনের। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার ক্ষমতাশীল একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাধর কিছু নেতৃবৃন্দের সাথে তাদের কয়েক জনের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। একটি রাজনৈতিক প্রোগ্রামে মোটা অংকের অর্থ স্পন্সর করার সুত্রে দাওয়াত পান ফখরুল ও তার কয়েক সহযোগী। শুধু তাই নয়, দেখা করেছিলেন স্বয়ং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম তার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়ায় দেশে ফিরে এখন নিজেকে বঞ্চিত দাবী করে শুরু করেছে নানা অপতৎপরতা। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়া ও নানা সংকটের জন্য দায়ী বায়রার এই নেতা। তার হাত ধরেইন সর্বনাশ নেমে এসেছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে।
বায়রার একজন সদস্য বলেন, মালয়েশিয়ার জনশক্তি রপ্তানীতে একক ব্যক্তি হিসেবে সবচাইতে লাভবান ফকরুল ইসলাম। বেনামে একশ’ এক রিক্রুটিং এজেন্সিরও দুটি তার। তার মেডিকেল সেন্টারের নামে ওয়েলকাম ডায়াগনস্টিক এন্ড মেডিকেল সেন্টার। তার রিক্রুটিং এজেন্সির নাম হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আরেল ৪৫২)। একশ’ এক সিন্ডিকেট ভুক্ত তার বেনামী প্রতিষ্ঠান ত্রিবেনি ইন্টারন্যাশনাল ও সেলিব্রেটি ইন্টারন্যাশনাল। যার নেপথ্য মালিক ফখরুল ইসলামের। তিনি নিজের লাইসেন্স সরাসরি ব্যবহার না করে অন্যের নামে ব্যবসা করছেন। অন্য যারা ব্যবসা করেন তাদের লাইসেন্স একটা অথচ উনার দু’টি লাইসেন্স। তাছাড়া অন্য ব্যবসায়ীরা হয়তো মূল একশ এক এজেন্সির মধ্যে অথবা সহযোগী রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে ছিলেন। কেউ কেউ শুধু মেডিকেল সেন্টারে ছিলেন। তিনি একমাত্র ব্যক্তি সব জায়গায় আছেন। তিনি মালয়েশিয়া থেকে ডিমান্ড (চাহিদাপত্র) সংগ্রহ করে বিভিন্ন এজেন্সিকে সরবরাহ করেছেন। তারা ডিমান্ড সংগ্রহ করার শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার।
অপর একজন ব্যবসায়ী জানান, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালৈর ৩১ মে পর্যন্ত ৪ লাখ ৭২ হাজার ৪৭৬ জন শ্রমিক মালয়েশিয়া গেছে। চলতি বছরের শুরুতে শ্রমিক পাঠানোর শুরু থেকেই মন্ত্রণালয় বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেয়নি। পরে দেখা যায় প্রতিবেশি সকল দেশ মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর সোর্স কান্ট্রি হওয়ায় এবং হজ মওসুম হওয়ায় এয়ার লাইন্সের টিকেট সংকট দেখা দেয়। একারনে অনেক শ্রমিক যেতে পারেনি। সংশ্লিষ্টরা জানান, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট গঠনের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকার বন্ধ শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। এর আওতায় ২০২২ সালের ২ জুন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং মিটিংয়ে অনলাইনভিত্তিক স্বচ্ছ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের সরবরাহ করা এজেন্সি থেকে সীমিত সংখ্যক এজেন্সি নির্বাচিত করেন। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ১ হাজার ৫২০টি বৈধ লাইন্সের মধ্য থেকে মালয়েশিয়া সরকার প্রথমে ২৫টি ও পরে ১০১টি লাইন্সে তালিকাভুক্ত করে। এজেন্সিগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়ান সরকারের সফটওয়্যার সিষ্টেমের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় বরাদ্দ পদ্ধতি অনুসরণ করে কর্মী নিয়োগের কোটা বরাদ্দ করা হয়। কোটার অনুকুলে বাংলাদেশ হাইকমিশন ডিমান্ড লেটার সত্যায়ণ এবং মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ অনুমতির পর কর্মীদের মেডিকেল, কলিং ভিসা ও ই-ভিসা সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে বিএমইটি’র বহির্গমন ছাড়পত্র প্রাপ্তির পর কর্মীদেরকে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। তালিকাভূক্ত এজেন্সিগুলো স্বয়ংক্রীয় পদ্ধতিতে বরাদ্দ পাওয়ায় ভিসা ক্রয়ের প্রয়োজন হয়নি। বরাদ্দপ্রাপ্ত কোটার কর্মীদেরকে নির্ধারিত পদ্ধতিতে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনুমোদনহীন এজেন্সিগুলো কর্মীদের নিকট থেকে অধিক অর্থ গ্রহণ ও ভিসা ক্রয় বাণিজ্য গোপন করার স্বার্থে অনুমোদিত এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগও করছে। অনুমোদনহীন অনেকে ভিসা ক্রয় বাণিজ্যে জড়িয়ে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে ভিসা প্রস্তুত করছে এবং তারা সরাসরি কর্মী সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। তালিকাবর্হিভূত প্রায় ১১শ’ মধ্যস্বত্বভোগী অনুমোদনহীন এজেন্সী নিয়োগকারীর কাছ থেকে ডামি ডিমান্ড লেটার ও পাওয়ার অব এ্যটর্নী নিয়ে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ায় অভিবাসন ব্যয় কয়েকগুন বেড়ে যায়। । এই অভিবাসী শ্রমিকরা দেশের জন্য গত ৩বছরে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন।