সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ কর্মসূচি পর্যায়ক্রমে অভ্যুত্থানের রূপ লাভ করে চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে। যার মাধ্যমে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। তবে এর আগে আন্দোলন দমনের সর্বাত্মক চেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাশাপাশি আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করতে দেখা যায় সরকারদলীয় তৃণমূল নেতাকর্মী ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদেরও। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিক্ষোভকারী ছাত্র-জনতার অবস্থান লক্ষ্য করে গুলী করার ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১২ জেলায়। অন্য জেলাগুলো হলো চট্টগ্রাম, ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, রংপুর, জামালপুর, হবিগঞ্জ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, সিলেট ও লক্ষ্মীপুর। সরকার পতনের পর বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এ ১২টি জেলায় ১২৬ জন অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে, এদের মধ্যে বড় অংশই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে শনাক্ত হওয়া ১০ জন অস্ত্রধারীর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩ জনকে। ফেনীতে শনাক্ত হওয়া ৩৩ জন অস্ত্রধারীর মধ্যে ১ জনকে, কেরানীগঞ্জে ৪ জনের মধ্যে ১ জনকে এবং সিরাজগঞ্জে ২ জনের মধ্যে ১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার এ ৬ জনের মধ্যে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাকি ২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। অবশ্য অস্ত্রধারীদের সঙ্গে হামলায় অংশ নেয়া বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তবে শনাক্ত হওয়া অস্ত্রধারীদের ধরতে চেষ্টার কোনো কমতি নেই বলে দাবি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। অনেকেই নজরদারিতে আছেন। তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
আলোচিত ভিডিওগুলোর মধ্যে একটি ফুটেজে দেখা যায়, ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে অস্ত্র হাতে গুলী ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাচ্ছেন এক যুবক। পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, ওই যুবক ঢাকা উত্তর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ। তিনি সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাতিজা। গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছিল। সেদিন আসিফের নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালিয়েছিলেন। একইদিন এ রকম আরেকটি ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে, যেটি মোহাম্মদপুরের। সেদিন মোহাম্মদপুরের বছিলা সড়কেও ছাত্র-জনতার ওপর গুলী ছোড়া হয়েছিল। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ঢাকা উত্তরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আরেকজন সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান ওরফে রাজীব এবং সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী মাসুদুর রহমান ওরফে বিপ্লব আগ্নেয়াস্ত্র হাতে গুলী ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাচ্ছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের শুরুতে রাজধানীর যেসব এলাকা উত্তাল হয়ে উঠেছিল, তার মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদপুর। এর মধ্যে ১৭-২১ জুলাই এবং ৪ আগস্ট মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বছিলা পর্যন্ত সড়কে অবস্থানকারী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করা হয়েছিল। আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মোহাম্মদপুর এলাকায় দলবল নিয়ে সক্রিয় ছিলেন সাবেক দুই কাউন্সিলর আসিফ ও রাজীব এবং বিপ্লব। গত ৫ আগস্ট দুপুরের পর আত্মগোপনে চলে যান তারা। এখন পর্যন্ত তাদের কাউকেই গ্রেপ্তার করা যায়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীকেও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলী করতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার সময় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এমন ১০ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে, যারা সবাই চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মী। চট্টগ্রাম শহরে আন্দোলন দমনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাবেক উপ-অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী ওরফে বাবরকে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত তিনি। এ ছাড়া যুবলীগের কর্মী মো. তৌহিদ ও মো. ফিরোজকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে। ভিডিও ফুটেজে শনাক্ত হয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী মো. দেলোয়ারও। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দুই মাসে শত শত মামলা হয়েছে, পুলিশ ও প্রশাসনের সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রদবদল হয়েছে; এরপরও অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি কেন এ বিষয়ে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) কাজী মো. তারেক আজিজ গণমাধ্যমকে বলেন, থানায় হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় মাঝখানে অভিযান চালানো যায়নি। এই সুযোগে অস্ত্রধারীদের বেশিরভাগই গা-ঢাকা দিয়েছেন। এখন অস্ত্রধারীদের শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।