দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আসন্ন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় বাংলাদেশ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছে। এবারের সভায় বাংলাদেশ সাইড লাইনে দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সঙ্গে আলাদা একাধিক বৈঠক করবে। এসব বৈঠকে তিনটি ইস্যু প্রাধান্য দেবে। এগুলোর মধ্যে অগ্রাধিক পাবে আইএমএফ থেকে বাড়তি ঋণের ৩০০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয় গুরুত্ব, বাংলাদেশ থেকে পাচার টাকা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে জব্দ করে রাখা এবং তৃতীয় গুরুত্ব ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও ১৫ বছরের লুটপাটের চিত্র তুলে ধরা।
সূত্র জানায়, আগামী ২১ থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে এ বৈঠক হবে। এতে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। বাংলাদেশের পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেবেন। এর আগে সংস্থা দুটির পরপর দুটি বৈঠকে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। ফলে নতুন পরিস্থিতিতে বৈঠকে বাংলাদেশের জন্য আলোচনার বিষয়ও পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগের বৈঠকগুলোতে সংস্থা দুটি থেকে শুধু বাড়তি সহায়তা আদায় ও দেশের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হতো। এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপট যুক্ত হয়েছে। গত আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই সংকট কাটাতে নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েই আইএমএফের কাছে আরও ৩০০ কোটি ডলার সহায়তা চেয়েছে। এর আগে আইএমএফ ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ওই বছরের এক ফেব্রুয়ারি ঋণের প্রথম কিস্তি হিসাবে ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার ছাড় করে। একই বছরের ডিসেম্বরে ছাড় করে দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত ২৪ জুন তৃতীয় কিস্তি বাবদ ছাড় করেছে ১১৫ কোটি ডলার। তিন কিস্তিতে মোট পেয়েছে ২৩১ কোটি ডলার। চতুর্থ কিস্তির অর্থ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়ার কথা।
চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতা আরও ৩০০ কোটি ডলার বাড়ানোর প্রস্তাবের কারণে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও চতুর্থ কিস্তির ছাড়ের শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইএমএফের একটি মিশন বাংলাশে সফর করে গেছে। ওই মিশন ৩০ সেপ্টেম্বর একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রমকে স্বাগত জানিয়ে আইএমএফ বলেছে, এ কাজে তারা বাড়তি সহায়তা করতে নীতিগতভাবে সম্মত। এ বিষয়ে আসন্ন আইএমএফের বার্ষিক সভায় বিস্তারিত আলোচনা হবে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে। আইএমএফও এ বিষয়ে প্রস্তুতির অংশ হিসাবে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এর আলোকে আইএমএফ একটি প্রতিবেদন তৈরি করে সেটি তাদের নির্বাহী পরিষদের সভায় উপস্থাপন করবে। এর আগে বার্ষিক সভায় সাইড লাইনে বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে বাড়তি ঋণ সহায়তার বিষয়টি চূড়ান্ত করবে।
এদিকে গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দেশ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ পাচার করেছেন সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। এছাড়া মন্ত্রী, এমপি ও রাজনৈতিক নেতারাও টাকা পাচার করেছেন। এসব টাকার গন্তব্য ও কারা পাচার করেছেন সে বিষয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে। এসব তথ্যের আলোকে বৈঠকে অংশ নেওয়া সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করবে। বৈঠকে সদস্য দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা অংশ নিয়ে থাকেন। পাচার করা টাকা জব্দ করার বিষয়ে তারাই যথাযথ কর্তৃপক্ষ। এ কারণে ওই বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করা হয়েছে এমন ১০-১২টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল বৈঠক করবে। ওইসব দেশের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নিতে বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধি দল যাবে। তারা পৃথকভাবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পাশাপাশি অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বৈঠকে করবে। বৈঠকগুলোতে পাচার হওয়া সম্পদ জব্দের বিষয়ে আলোচনা হবে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে গত সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও ব্যবসায়ী যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মরিশাস, বেলারুশ, সুইজারল্যান্ড, ভারতসহ কয়েকটি দেশে বেশি মাত্রায় টাকা পাচার করেছেন। ওইসব সম্পদ দিয়ে তারা সেসব দেশে যেমন কোম্পানিগুলো গঠন করে ব্যবসা করছেন, তেমনি কিছু টাকা ব্যাংকেও মেয়াদি আমানত হিসাবে রেখেছেন। বাংলাদেশের এখনকার কৌশল হচ্ছে, ওইসব টাকা এখনই দেশে আনা যাবে না। দেশে ফেরত আনতে গেলে বহুমুখী জটিলতা মোকাবিলা করতে হবে। এ কারণে তারা ওইসব সম্পদ যে দেশে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় রেখেই শুধু সরকারের নিয়ন্ত্রণ আনতে চায়। অর্থাৎ কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ থাকলে ওই কোম্পানির মালিকানা ব্যক্তির কাছ থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। একই সঙ্গে বিদেশের কোনো ব্যাংকে থাকলে সেগুলো ওই ব্যাংকে রেখেই শুধু হিসাব পরিবর্তন করতে চায়। এখন আছে পাচারকারীর হিসাবে। এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়।
এসব লক্ষ্য নিয়ে ওইসব দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবে বাংলাদেশ। বৈঠকে দেশের পক্ষ থেকে আপাতত পাচারকারীদের সম্পদ জব্দ করার প্রস্তাব দেওয়া হবে। এজন্য যারা টাকা পাচার করেছেন তাদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হবে। বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গেও আলোচনা হবে। পাইপলাইনে আটকে থাকা অর্থ ছাড়সহ ঋণের জোগান বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হবে। এছাড়া দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র সংস্কার ও বিদায়ি সরকারের আমলে গণহত্যার বিষয়টিও তুলে ধরা হবে।