অসময়েই করা হয় ঢাকার সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি। আর এমনভাবে কাজ করা হয় চলে সারা বছরজুড়ে। সড়কের মেরামত কাজে ঢাকা যেন হয়ে পড়ে ক্ষতবিক্ষত। নিত্যদিনই দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীর। হাসিনা সরকারের পতনের পর এই পরিস্থিতি যেন আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছে। সেবা সংস্থার ও সড়ক উন্নয়ন কাজে এসেছে স্থবিরতা। এখন পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপ। মূল সড়ক, অধিকাংশ অলিগলির সড়কের অবস্থাই বেহাল। আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আত্মগোপনে আওয়ামীপন্থি সব মেয়র-কাউন্সিলর। যার একটি বড় প্রভাবও রয়েছে সড়ক সংস্কারে।
জানা যায়, তীব্র যানজট, দূষণের পাশাপাশি সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করায় শহরে নাগরিক দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েকগুণ। অনেক সড়কে যান চলাচলও বন্ধ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংশ্লিষ্টদের দাবি, চলতি বর্ষা মৌসুমে অতিভারী বৃষ্টি ও পানিবদ্ধতার কারণে ঢাকার সড়কের এই বেহাল দশা। ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার (ডিএনসিসি ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার, ডিএসসিসি ১০৯ দশমিক ২৫১ বর্গ কিলোমিটার) এলাকা নিয়ে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি গঠিত। এর মধ্যে ডিএসসিসি এলাকায় ৯৯৩ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। ডিএনসিসি এলাকায় রয়েছে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার সড়ক। এখন এসব সড়কের এক-তৃতীয়াংশ এখন ভাঙাচোরা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাধীন সড়কসমূহে সৃষ্ট গর্ত ও খানাখন্দের মধ্যে অনেক সড়কের সংস্কার কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে এবং চলতি অক্টোবরে মাসের মধ্যে বাকী সড়কগুলোর সংস্কার কাজ শেষ হবে। ফলে, আগামী নভেম্বরে মাসে নগরবাসী এসব সংস্কার কাজের সুফল ভোগ করতে পারবে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ।
রাজধানীর মতিঝিল গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হলেও এর আশপাশের বিভিন্ন সড়ক ভাঙাচোরা ও গর্তে ভরা। দীর্ঘদিন সড়কে কাজ বন্ধ থাকায় কঠিন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। মতিঝিল টিকাটুলির মূলসড়কে রয়েছে বড় বড় গর্ত। এই সড়কে বাসসহ যানবাহন চলে হেলেদুলে। মধুমিতা সিনেমা হলের সামনের সড়কটি অর্ধেক কাজ ফেলে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারের সামনের সড়কে বড় বড় গর্ত করে কাজ ফেলে রাখা হয়েছে। যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে দয়াগঞ্জ সড়কে ছোট-বড় গর্ত। দয়াগঞ্জ বাজার অংশের অবস্থা ভয়াবহ। জুরাইন রেলগেট থেকে দয়াগঞ্জ সড়কটিও চলাচলের অনুপযোগী। এ সড়কের অবস্থা এতটাই খারাপ যে উল্টে যাওয়ার ভয়ে বড় যানবাহন চলছে না। দয়াগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী ও দয়াগঞ্জ থেকে জুরাইন এ দুটি সড়ক তিন-চার বছর ধরে বেহাল অবস্থায় রয়েছে। খিলগাঁও মধ্যপাড়া এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা কেটে রাখা হয়েছে। খিলগাঁও থেকে সবুজবাগ, মুগদা, মানিকনগর, গোলাপবাগ হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত সড়কে শত শত গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড খুঁড়ে রাখা হয়েছে। নর্থ-সাউথ রোড, নয়াবাজার, বাবুবাজারের প্রধান সড়কগুলোও খুঁড়ে রাখা হয়েছে। মৌচাক, হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, আজিমপুর, পলাশী, লালবাগের বিভিন্ন রাস্তার অবস্থাও ভালো নয়।
এদিকে শাহজাদপুরের বাঁশতলা সড়কটি প্রায় তিন বছর ধরে খানাখন্দ অবস্থায় পড়ে আছে। বাড্ডা লিংক রোড থেকে বাঁশতলা পর্যন্ত সড়কটি ছোটবড় গর্তে ভরা। বাড্ডা লিংক রোড থেকে দক্ষিণ বাড্ডা পর্যন্ত লেক পাড়ের সড়কটিতেও খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। নদ্দা থেকে কুড়িল বিশ্বরোড সড়কটি পাতাল রেলের কাজ চলমান থাকায় অর্ধেকই খোঁড়া। এর শাখা সড়কগুলোর অবস্থাও ভয়াবহ। বসুন্ধরা ওভারব্রিজ গেট থেকে জোয়ার সাহারা বাজারগামী সড়কটির বেহালদশা। মহাখালী টার্মিনালের সামনের রাস্তাটিও ভাঙা। কয়েকটি স্থানে রাস্তা উঁচু-নিচু হয়ে আছে। তেজগাঁও সাতরাস্তা, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, ইন্দিরা রোড, মিরপুরের বিভিন্ন সড়কসহ নতুন ওয়ার্ডগুলোর বিভিন্ন সড়কে খানাখন্দ। মোহাম্মদপুর এলাকার বেশির ভাগ সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু হয় এ বছরের শুরুতে। আসাদ গেট থেকে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজ পর্যন্ত সড়কের এক পাশে প্রায় দুই ফুট চওড়া করে কাটা হয়েছে। কাটা অংশ দেবে গিয়ে মূলরাস্তা থেকে নিচু হয়ে গেছে। আসাদ গেট থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার সড়ক আসাদ অ্যাভিনিউর চিত্রও একই। কাটাসুর, শের-শাহ সুরি রোড, তাজমহল রোড, বাঁশবাড়ি রোড, রাজিয়া সুলতানা রোড ও নুরজাহান রোডের সংযোগ সড়কগুলোর কোথাও এক পাশে, কোথাও কিছু দূর পরপর আড়াআড়ি করে কেটে রাখা হয়েছে। মোহাম্মদপুরে নবোদয় ও মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেডের প্রধান রাস্তা, রিং রোড, ইকবাল রোড, আওরঙ্গজেব রোড, গজনবী রোড, শাহজাহান রোড, হাজি চিনু মিয়া রোড, জান্নাতবাগ, বাবর রোড, মাদরাসা রোডেও চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে শ্যামলীর দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ও মিরপুর সড়কের অবস্থাও খারাপ। তুরাগের সুনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম সানবিমস স্কুলের সামনের সড়কের বেহাল দশা। যোগাযোগ ব্যবস্থা দৈন্যদশার কারণে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। দক্ষিণখান ও উত্তরখানের রাস্তার উন্নয়নের কাজ অতিদ্রæত শেষ করে যাতায়াতের উপযোগী করার দাবিতে মানববন্ধন করেন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা। সড়ক উন্নয়ন কাজ ধীর গতির কারণে উত্তরখান-দক্ষিণখান এলাকায় বসবাসরত লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না।
টিকাটুলীর বাসিন্দা কাজী শফিকুল ইসলাম বলেন, রাস্তাঘাট সংস্কারের যে কাজ চলমান ছিল তা এখন স্থগিত হয়ে আছে। মূল সড়কের বেহাল দশা। সরকারের পটপরিবর্তনের আগে ভেতরে অলিগলিতে যেসব রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি করে রাখা হয়েছে তা এখনও সেই অবস্থায় আছে। বিশাল বিশাল গর্ত হয়ে। ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন কার্যক্রম স্থবির। আগে নিয়মিত মশক নিধন কর্মসূচি হতো। না হলে সরাসরি কাউন্সিলর অফিসে গিয়ে কেন হচ্ছে না, কবে হবে সেটা জানা যেতো। এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থার অবনতি হয়েছে।
দক্ষিণখান-উত্তরখান সচেতন নাগরিক কমিটির আহŸায়ক ইয়াছিন রানা বলেন, ২০১৬ সালে এই এলাকা ঢাকা উত্তর সিটির আওতায় আসার পর থেকে পরিপূর্ণরূপে উন্নয়ন কাজ বন্ধ ছিল। বৃষ্টি হলেই পুরো এলাকা তলিয়ে যায়, হাটার মত অবস্থা থাকে না। সড়ক খনন নীতিমালা না মেনে সব রাস্তা এক সাথে কাটায় স্বাভাবিকভাবে মানুষ যাতায়াত করতে পারে না। অনেক এলাকায় কোনো গাড়িই চলাচলের সুযোগ নেই। বৃষ্টি হলেই রিকশা চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম বলেন, চলমান বর্ষায় অনেক সড়কে পানি জমে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো সংস্কার শুরু করছি। বড় গর্তগুলোতে সাময়িকভাবে ইটপাথর দিয়ে সমান করছি। চলতি মাসব্যাপী এ কার্যক্রম চলবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, নগরবাসীর ভোগান্তি লাঘব করা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এ. এফ. হাসান আরিফের নির্দেশনা এবং প্রকৌশল বিভাগের তৎপরতায় ইতোমধ্যে অনেকগুলো সড়কের খানাখন্দ ও বড় বড় গর্ত মেরামত করতে সক্ষম হয়েছি। যে সকল সড়কে মেরামত কাজ বাকী আছে সেসব সড়কের মেরামত কাজ এ মাসের মধ্যেই শেষ হবে এবং আগামীমাস থেকে নগরবাসী এসব কার্যক্রমের সুফল ভোগ করবে। আমরা সড়কগুলো জনগণের চলাচল উপযোগী করে সংস্কার করছি। বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেলে প্রয়োজনীয়তা অনুসারে কিছু কিছু সড়ক পুনঃনির্মাণ করব। অনেকগুলো সড়ক নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও পূর্ণাঙ্গভাবে সংস্কারের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দরপত্র আহŸান করা হয়েছে। বর্ষা পুরোপুরি শেষ হলে এসব সড়কের নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও পূর্ণাঙ্গভাবে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে এবং নগরবাসী সেসব কাজেরও পূর্ণ সুফল ভোগ করবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রফেসর শামসুল হক বলেন, সারা বছর চলাচলযোগ্য রাখতে হলে মানসম্মত সড়ক বানাতে হবে। পাশাপাশি বর্ষায় পানিবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। পিচঢালাই দেওয়া সড়ক যত ভালোভাবেই তৈরি করা হোক না কেন, পানিবদ্ধতা হলে তা টিকিয়ে রাখা কঠিন। বর্ষা হলেই যে পানিবদ্ধতা হয় তা নয়, অনেক সময় ড্রেন উপচে, ম্যানহোল উপচেও সড়কে পানি আসে। গুণগত মান ঠিক না থাকায় অলিগলির রাস্তা টেকে না। তদারকির অভাব কমবেশি থাকেই। সড়কে কিছুদিন পর কাটাকাটির মানে হলো সঠিক পরিকল্পনার অভাব।