সাগরের কম গভীরতার কারণে বড় জাহাজ (মাদার ভেসেল) চলাচল করতে না পারায় ছোট জাহাজে (লাইটারেজ) করে নিয়ে এসে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে (ইআরএল) জ্বালানি তেল পরিশোধন করা হয়। এভাবে লাইটারেজ জাহাজে করে তেল পরিবহন যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি অপচয়ও হয়। এ জন্য প্রতিদিন পরিশোধনাগারটির খরচ হয় ৬৬ কোটি টাকা!
এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ হচ্ছে সাগরে থাকা বড় জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে তেল নিয়ে আসা। পাশাপাশি পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার টার্মিনালে তেল পাঠানো। ৮ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা খরচায় বাস্তবায়ন করা প্রকল্পটির কমিশনিংয়ের কাজ শেষ হয় গত মার্চে। আগস্টে প্রকল্পটি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) বুঝিয়ে দেয় ইআরএল কর্তৃপক্ষ। এর পর প্রকল্পটির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু না করায় পাইপলাইনের কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসপিএমে কাজ করার সক্ষমতা দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। জ্বালানি পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে প্রকল্পটি চালু করা গেলে সাগরের বহির্নোঙরে জাহাজ থেকে তেল খালাসে গতি আসবে। বছরে সাশ্রয় হবে ৮০০ কোটি টাকা।
বিপিসি ও ইআরএল কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি পাইপলাইনের মাধ্যমে জাহাজ থেকে তেল আনার কাজটি করবে। তাদের সঙ্গে থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজটি শিখে নেবে দেশীয় লোকবল। পরে তারাই এটি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করবে। এ জন্য ইতোমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগের কাগজপত্রও তৈরি করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এ প্রক্রিয়া শেষ করা হবে।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এসপিএম প্রকল্প পরিচালক মো. শরীফ হাসনাত সমকালকে বলেন, ‘মার্চে কমিশনিংয়ের পর আনুষঙ্গিক কাজ শেষে এসপিএম প্রকল্পটি আগস্টে বিপিসিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ জ্বালানি নিরাপত্তা বিধান বাতিল হওয়ায় নতুন করে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলসের আওতায় জিটুজি পদ্ধতিতে অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিপিসি এখন ঠিকাদার নিয়োগে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আমিও এতে সম্পৃক্ত। জাহাজ থেকে পাইপলাইনে তেল নিয়ে আসা ও প্রকল্পটি রক্ষণাবেক্ষণে চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। প্রকল্পটির বর্ধিত মেয়াদ এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আছে।
কক্সবাজারের মাতারবাড়ী দ্বীপের স্টোরেজ ট্যাঙ্ক থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে সাগরে ভাসমান বয়াটির অবস্থান। ২২০ কিলোমিটার সমান্তরালে দুটি পাইপলাইনের সঙ্গে সেটি সংযুক্ত। এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার পাইপলাইন অফশোর বা সাগরের তলদেশে এবং ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইন অনশোর বা স্থলভাগে স্থাপন করা হয়েছে। বড় জাহাজ থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল প্রথমে মহেশখালীর ট্যাঙ্ক টার্মিনাল, পরে সেখান থেকে পতেঙ্গায় তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাঙ্ক টার্মিনালে নিতে এগুলো স্থাপন করা হয়েছে।
জানা যায়, চীনের অর্থায়ন ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসপিএম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এতদিন আমদানি করা জ্বালানি তেল বড় জাহাজ থেকে লাইটার জাহাজে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ট্যাঙ্কে আনা হতো। এতে সময় লাগত ১১ থেকে ১২ দিন। প্রকল্পটি চালু হলে সমপরিমাণ তেল পরিবহনে সময় লাগবে মাত্র দু’দিন। প্রকল্পের আওতায় মহেশখালীতে ছয়টি স্টোরেজ নির্মাণ করা হয়, যা ইআরএলের জ্বালানি তেল ধারণের সক্ষমতা দুই লাখ টন বাড়ায়। ফলে এখন আড়াই মাসের চাহিদার সমান তেল মজুত করা সম্ভব। অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে সরবরাহ ব্যাহত হলে যা অতিরিক্ত নিরাপত্তা মজুত থাকার সুবিধাও যোগ করেছে। তবে এখনও অপারেটর নিয়োগ দিতে না পারায় এসব সুফল অধরাই রয়ে গেছে।
মার্চ থেকেই এটি চালু হওয়ার কথা ছিল। পরে গত বছরের জুলাইয়ে সৌদি আরবের ৮২ হাজার টন একটি জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ থেকে প্রথমবারের মতো পাইপলাইন দিয়ে পরীক্ষামূলক তেল সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন বড় কারিগরি ত্রুটির কারণে সাগর থেকে পাইপলাইনে মহেশখালীর কালারমারছড়ায় তেল নিয়ে আসার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। পরে ত্রুটি সারিয়ে তা শুরু করতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
ইআরএল বিপিসির আওতাধীন। বিপিসির সংশ্লিষ্ট এক পরিচালক জানিয়েছেন, ঠিকাদার নিয়োগের সব প্রক্রিয়া শেষে প্রকল্পটি চালু করতে ছয় থেকে সাত মাস সময় লাগতে পারে। প্রকল্পের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড তিন বছরের জন্য এসপিএম পরিচালনার আগ্রহ দেখাচ্ছে।
এদিকে ইআরএলে যেসব জাহাজে তেল পরিবহন করে, এর মধ্যে দুটিতে সম্প্রতি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে জাহাজ দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে তেল পরিবহনে বড় ধাক্কা লেগেছে।