বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী বা চৌধুরী আলমের কথা অনেকেই ভুলে গেছেন। এছাড়াও পতিত আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে দেশে অন্তত ৭শ’ মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। গুমের শিকার কয়েকটি পরিবারের আকুতি শুধু সমাবেশ ও মানবনবন্ধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কেন এত মানুষকে গুম করা হয়েছিল? কোথায় বন্দী রেখে তাদেরকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়? যাদের খোঁজ এখনো মেলেনি তারা কি বেঁচে আছেন- এই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অর্ন্তবর্তী সরকার গঠনের পর বেরিয়ে আসতে শুরু করে গুমরহস্য। গঠন করা হয় গুম কমিশন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দাবি করেছে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে দেশে ৭শ’ মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। তবে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার বলছে, এ সময় দেশে ৬৭৭ জন গুমের শিকার হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলেছে, গুমের শিকার হয়েছেন ৬১১ জন। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন মতে, গত ১৩ বছরে গুমের শিকার হয়েছেন ৬২৩ জন। এদিকে গুমের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালকের কাছে সম্প্রতি বিভিন্ন সময় গুমের শিকার ১৫৮ ব্যক্তির একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমনে ১৫ বছরে গুমকে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিটি ইউনিট, গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে গুমের সংস্কৃতি গড়ে তোলে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা যাতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনে যোগ না দিতে পারেন, ক্ষমতাসীনদের লাগামহীন দুর্নীতির পথে বাধা হয়ে না দাঁড়াতে পারেন, সে জন্য তৈরি করা হয় এই ভয়ের সংস্কৃতি। সাদা পোশাকে তুলে নেয়া হতো বিরোধী নিতো-কর্মীকে। এমনকি সরকারের জন্য সামান্যতম হুমকি হতে পারে এমন ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, ছাত্র যে কাউকেই গুম করে নেয়া হতো। কেউ প্রতিবাদ করার মতো সাহস পোতা না। এমনকি গুমের শিকার পরিবারগুলো কোনো ভাবে মুখ খোলারও সাহস পেতো না। তাদেরকেও বিভিন্ন ভাবে হুমকি দেয়া হতো। দীর্ঘ দিন পর কখনো কোনো উপায়ে কেউ ফিরে আসলেও তারা মুখ খোলার সাহস পেতো না। শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদি সরকারের ভয় ভেঙেই রাজপথে নেমে আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। পতনের আগমুহূর্তেও জনমনে ভীতি সঞ্চারে শেষ অপচেষ্টা করা হয়। প্রাণ দিতে হয় হাজারো ছাত্র-জনতাকে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগেও এই ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘সুশাসন ও জবাবদিহির অভাবে দেশবাসী এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতিতে বাস করছে। এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান গতকাল দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, ‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে গুমের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গুমের ঘটনা ব্যাপক আকার ধারণ করে। তিনি বলেন, এরপর প্রতি মাসেই গুমের ঘটনা ঘটতে ছিল। কোনো মাসে কম কোনো মাসে বেশি কিন্তু এরপর থেকে দেশে গুমের ঘটনা চলমান ছিল । নাসির উদ্দিন এলান বলেন, এ ছাড়াও জঙ্গি সন্দেহে দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু ইসলামপন্থী মানুষকে গুম করা হয়েছে। অনেক আলেম ওলামাকে জঙ্গি আখ্যা দিয়ে গুম করে নেয়া হয়েছে। এই পরিবারগুলো নিরীহ হওয়ায় আলোচনায় আেেসনি। মানবাধিকার কর্মী নাসির উদ্দিন এলান বলেন, এর মাধ্যমে দেশে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়, যাতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনে যোগ না দেন। এই অপকর্মে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ অনেক নেতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা মিলিতভাবে গুমের ঘটনাগুলো ঘটিয়েছেন। আমাদের সংগঠনের কাছে এই মুহূর্তে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৭০৯ জনকে গুম করার তথ্য রয়েছে। এর পরও ৫ আগস্ট পর্যন্ত অনেক গুম ও খুনের ঘটনা ঘটেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলার সময় অনেককে গুম করা হয়। আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদকে গুম করা হয়। বিএনপিসহ ভিন্নমতের অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
২০২০ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ৩৪ জনের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে বাংলাদেশে চিঠি দেয়া হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি চিঠি পাঠায়। এই চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের বিশেষ শাখা হয়ে ওই চিঠি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু চিঠি চালাচালির মধ্যেই ছিল এই তদন্ত সীমাবদ্ধ। আওয়ামী লীগের আমলে এসব গুমের বিষয় কোনো তদন্ত করা হয়নি, এমনকি গুমের ঘটনা স্বীকারই করেনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গুমের শিকার পরিবারগুলো তাদের প্রিয়জনদের ফেরত পাওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দাবি জানান। আইনশৃঙ্কলা বাহিনীর হাতে আটকের পর নিখোঁজ ব্যক্তিদের ফেরত পেতে স্বজনেরা খোঁজ জানতে চান। এরপর অল্প সময়ের মধ্যে আট বছর ধরে নিখোঁজ থাকা সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মীর আহমাদ বিন কাসেম (আরমান) বন্দিশালা থেকে মুক্তি পান। আবদুল্লাহিল আমান আযমী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মরহুম গোলাম আযমের মেজো ছেলে। আর মীর আহমাদ বিন কাসেম (আরমান) মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাজানো আদালতে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ছেলে। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম আরমানকে নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে যান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। বাসা থেকেই দুই শিশুসন্তান, স্ত্রী ও বোনের সামনে থেকে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর আর তার হদিস পাওয়া যায়নি। এর কয়েক দিন পর ২৩ আগস্ট আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে গুম করা হয়।
মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি জানায়, গত ১৫ বছরে দেশে ছয় শতাধিক মানুষ গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গুমের শিকার অধিকাংশ ব্যক্তি আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরে অনেককে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে, আবার অনেকের লাশ পাওয়া গেছে। ১০০ জনের বেশি মানুষের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। গত বৃহস্পতিবার এমন তথ্য দিয়েছে। অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। একইসঙ্গে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যত গুম হয়েছে সব ঘটনার তদন্ত চাওয়া হয়েছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই অভিযোগ দাখিল করা হয়।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গুম কমিশনরে ১৩ দিনে ৪০০ অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। কমিশনের তদন্তে ‘আয়নাঘরের’ প্রমাণ মিলেছে। সাংবাদিক সম্মেলন করে কমিশনের চেয়ারম্যান হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী জানিয়েছেন, ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ থেকে ডিজিএফআই পরিচালিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলের প্রমাণ মিলেছে যা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত। ঢাকায় ডিজিএফআই সদর দপ্তরে একটি দোতলা ভবনে ২২টি কক্ষে এই সেল পরিচালিত হতো। মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগগুলো আমরা তদন্ত করছি। অভিযুক্তদের তলব করব। তারা হাজির না হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ গুমের অভিযোগ র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের বিরুদ্ধে। কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, গত ২৫ সেপ্টেম্বর আমরা ডিজিএফআই দপ্তরে আয়নাঘর পরিদর্শন করি এবং ১ অক্টোবর ডিবি ও সিটিটিসি কার্যালয় পরিদর্শন করেছি। তবে, সেসব জায়গায় কাউকে আটক অবস্থায় পাইনি। মনে হচ্ছে ৫ আগস্টের পর সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমিশনে গুম সংক্রান্ত অভিযোগ জমা দেওয়ার সময়সীমা ছিল। তবে কমিশন প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, অভিযোগ জানানোর সময়সীমা ১০ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘৭৫ জন ব্যক্তিগতভাবে এসে অভিযোগ দিয়েছেন। অনেকে ডাকযোগে বা ইমেইলে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। প্রয়োজনে অভিযোগ গ্রহণের সময়সীমা আরও বাড়ানো হতে পারে। তবে তিন মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ হবে কিনা তা পরে মূল্যায়ন করা হবে বলে জানান তিনি। কমিশনের সদস্য মানবাধিকার কর্মী নুর খান বলেন, আমরা ভুক্তভোগীদের তাদের পরিচয়ের ভিত্তিতে চিহ্নিত করব না। আমরা প্রতিটি অভিযোগ শুনতে চাই। আমরা বুঝতে চাই কী ঘটেছে এবং কীভাবে আইন লঙ্ঘন করে লোকজনকে আটক করা হয়েছে।