অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কবলে নিত্যপণ্যের বাজার। একটির পর একটি পণ্যের দাম বেড়েই চলছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ। সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু বাজারে গিয়ে প্রায় সব পণ্যই কিনতে হয় উচ্চমূল্যে। আলু, বেগুন, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতাসহ প্রায় সব ধরনের সবজিই অস্বাভাবিক দরে বিক্রি হচ্ছে। অপরদিকে চালের দামও বেড়েছে কেজি প্রতি ২ থেকে ৪ টাকা। দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ব্যবসায়ীরা দিচ্ছেন নানা অজুহাত। কিন্তু ভোক্তারা বলছেন, সরকারের বাজার মনিটরিং ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
জানা যায়, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের সময় থেকেই বাজারে এই অস্থিরতা চলছিল। ওই সরকারের ওপর মানুষের ক্ষোভের এটিও একটি কারণ। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর বাজার সহনীয় করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। নজরদারি বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দফায় দফায় সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো, টিসিবির মাধ্যমে সুলভে পণ্য বিক্রি বাড়ানো, বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক কমানোর পাশাপাশি ডিম, আলুসহ কয়েকটি পণ্য আমদানিরও সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, অতিমুনাফালোভী পুরনো সিন্ডিকেট আগের মতোই সক্রিয়। অনেক ক্ষেত্রে বেপরোয়া। আর পথে পথে পরিচয় বদলে চাঁদাবাজিও চলছে সমান তালে। পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি চাঁদাবাজ ও সিন্ডিকেটের হোতাদের চিহ্নিত করে কঠোর হাতে দমন না করলে বাজারে স্বস্তি ফেরানো কঠিন।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, সপ্তাহ ব্যবধানে সব ধরনের সবজির দাম ২০ টাকা থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গ্রীষ্মকালীন সবজি কচুরমুখীর কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, বেগুন ১০০ থেকে ১৪০ টাকা, করলা ৮০ থেকে ১০০ টাকা, কাঁকরোল ১২০ টাকা, পটল ১০০ টাকা, ঢেঁড়স ১০০ টাকা, বরবটি ১২০ টাকায়, পেঁপে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, ধুন্দল ১০০ টাকা, চিচিঙ্গা ১০০ টাকা, কচুর লতি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, ঝিঙ্গা ১২০ টাকা এবং শসার কেজি ৮০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা, চাল কুমড়া ৮০ টাকা এবং মিষ্টি কুমড়া ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচকলার হালি ৮০ টাকা আর লেবুর হালি রাখা হচ্ছে আকারভেদে ৩০ থেকে ৬০ টাকা। কাঁচামরিচের কেজি ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সরবরাহ কম থাকায় কাঁচামরিচের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন খুচরা বিক্রেতারা। তারা জানান, গত সপ্তাহের তুলনায় কাঁচামরিচের দাম কেজিতে ৬০ টাকা বেড়েছে।
বাজারে শীতকালীন সবজি শিম ৪৮০ টাকা কেজি, পাকা টমেটো প্রকারভেদে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, গাজর ১৮০ টাকা, মুলা ৮০ টাকা এবং জলপাই ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা পিস এবং বাঁধা কপি ছোট সাইজের প্রতি পিস রাখা হচ্ছে ৮০ টাকা। শাকের আঁটি মিলছে না ২০ টাকার নিচে। বাজারে লাল শাক ২৫ টাকা আঁটি, লাউ শাক ৫০ টাকা, মূলা শাক ২৫ টাকা, কলমি শাক ২০ টাকা, পুঁই শাক ৪০ টাকা এবং ডাঁটাশাকের আঁটি ৩০ টাকা বিক্রি করতে দেখা গেছে। ধনে পাতার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। দেশি পেঁয়াজ ১২০ টাকা, আদা ৩২০ টাকা, রসুন ২২০ টাকা, নতুন আলু ১২০ টাকা, বগুড়ার আলু ১০০ টাকা এবং পুরান আলু কেজি ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গত সেপ্টেম্বর মাসের বাজারদর ও রাজধানীর খুচরা বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক মাসের ব্যবধানে কাঁচা মরিচ কেজিতে ৮২ থেকে ১৫০ শতাংশ দাম বেড়ে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভালো মানের গোল বেগুন মানভেদে কেজিতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে ১৬০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে প্রতি কেজি করলা বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। এক মাসের ব্যবধানে টমেটো কেজিতে ৭৫ থেকে ৮৬ শতাংশ দাম বেড়ে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। পটোল কেজিতে ৬০ থেকে ৬৭ শতাংশ ও ঢেঁড়স কেজিতে ৬৭ থেকে ৮০ শতাংশ দাম বেড়ে যথাক্রমে ৮০ থেকে ১০০ এবং ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে গত সপ্তাহের মতো চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের মুরগি। গত সপ্তাহের মতোই ব্রয়লার মুরগি ২০০ থেকে ২১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। একই সঙ্গে সোনালি মুরগি কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ২৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনালি হাইব্রিড ২৬০ টাকা, দেশি মুরগি ৫২০ টাকা, লেয়ার লাল মুরগি ৩৩০ টাকা এবং সাদা লেয়ার মুরগি ৩২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব বাজারে গরুর গোশত কেজি প্রতি ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকা, গরুর কলিজা ৮০০ টাকা, গরুর মাথার গোশত ৪৫০ টাকা, গরুর বট ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা এবং খাসির গোশত কেজি প্রতি ১১৫০-১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারগুলোতে এক ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়, হাঁসের ডিম ২৩০ টাকায়, দেশি মুরগির ডিমের হালি ৯০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। অন্যদিকে বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ মাছ। এসব বাজারে ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছ কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা এবং ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের ইলিশ ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকা, এক কেজি ওজনের ইলিশ ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা এবং দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ২২০০ থেকে ২৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি চাষের শিং মাছ (আকারভেদে) বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৪৫০ টাকায়, প্রতি কেজি রুই মাছ (আকারভেদে) ৩৮০ থেকে ৫০০ টাকায়, দেশি মাগুর মাছ ৮০০ থেকে ১১০০ টাকা, মৃগেল ৩২০ থেকে ৪০০ টাকায়, চাষের পাঙ্গাস ২০০ থেকে ২২০ টাকায়, চিংড়ি ৭০০ থেকে ১৪০০ টাকায়, বোয়ালমাছ ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায়, কাতল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়, পোয়া মাছ ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়, পাবদা মাছ ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়, তেলাপিয়া ২২০ টাকায়, কৈ মাছ ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়, মলা ৫৫০ টাকা, বাতাসি টেংরা ১৩০০ টাকায়, টেংরা মাছ ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, কাচকি মাছ ৫০০ টাকায়, পাঁচমিশালি মাছ ২২০ টাকায়, রূপচাঁদা ১২০০ টাকা, বাইম মাছ ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা, দেশি কই ১২০০ টাকা, শোল মাছ ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা, আইড় মাছ ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকা, বেলে মাছ ৮০০ টাকা এবং কাকিলা মাছ ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব বাজারে পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল ৮১৮ টাকা, দেশি মসুর ডাল ১৪০ টাকা, মুগ ডাল ১৮০ টাকা, মিনিকেট চাল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা এবং নাজিরশাইল চাল ৭৫ থেকে ৮২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
প্রতি জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন
অন্তর্বর্তী সরকার শুল্কছাড় ও আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়ার মতো কিছু সুবিধা দিলেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। সে জন্য কঠোরভাবে বাজার মনিটরিংয়ে প্রতি জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এসংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় টাস্কফোর্স নিয়মিত বাজার মনিটর করছে। ব্যবসায়ীদের সতর্ক করার পাশাপাশি জরিমানাও করছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, সাধারণ মানুষ অতশত বোঝে না। তাদের প্রতিদিনই বাজার করতে হয়। প্রতিদিনকার পণ্য কিনতেই যদি আয়ের একটি বড় অংশ খরচ করতে হয়, তাহলে সংসারের বাকি সব চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় করে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। এটা করতে পারলে সরকারের অন্য সব কাজ করা সহজ হবে বলেও তাঁরা জানান।