তথ্যের বড় ধরনের গরমিলের কারণে অর্থনীতির চার খাতে সংস্কারের নির্দেশ দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেগুলো হচ্ছে-‘মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি’র প্রকৃত হার নিরূপণ, ‘রাজস্ব’ এবং ‘রপ্তানি’ আয়ের সঠিক হিসাব। সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সংস্কারের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে অর্থনীতির এই চারটি খাতে সংস্কারের কাজ শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
অর্থ বিভাগের মতে, প্রকৃত তথ্যে বড় গরমিল থাকায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভুল হিসাব তৈরি হচ্ছে। জিডিপির হার বাড়িয়ে দেখাতে গিয়ে খাদ্যের প্রকৃত উৎপাদন কম হলেও দেখানো হচ্ছে বেশি। এতে ঘাটতি মেটাতে খাদ্য আমদানি বাড়ানোর প্রয়োজন থাকলেও সেটি সামনে আসছে না। যে কারণে বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। যার প্রভাবে বেড়ে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতিও। এছাড়া রপ্তানি আয় বেশি হচ্ছে খাতাপত্রে দেখানো হলে এর ইতিবাচক প্রভাব রিজার্ভে পড়ছে না। অপরদিকে রাজস্ব আয়ের প্রকৃত তথ্য না থাকায় সরকারি ব্যয়ে অব্যবস্থাপনা হচ্ছে। এটি মোকাবিলায় সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি অঙ্কের ঋণ করতে গিয়ে চাপের মুখে ফেলছে অর্থনীতিকে। ফলে তথ্যের গরমিল থাকায় এসব খাতে বিদ্যমান নীতিগুলোর প্রকৃতপক্ষে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেটি আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
সূত্রমতে, অর্থনীতির এই চারটি খাতের (মূল্যস্ফীতি, জিডিপি, রাজস্ব ও রপ্তানি) সঠিক তথ্য প্রকাশের বিষয়টি প্রথম সামনে নিয়ে আসেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। দায়িত্ব গ্রহণের পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তিনি বলেছেন, বাড়িয়ে বা কমিয়ে নয়, এখন থেকে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তথ্য প্রকাশ করা হবে। তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিক নানা সূচকে তথ্যের গরমিল এখন থেকে আর হবে না। পরিসংখ্যান ব্যুরো যাতে আরও সঠিকভাবে কাজ করতে পারে, সেদিকে নজর দেওয়া হবে।
সূত্র আরও জানায়, রপ্তানি এবং রাজস্ব আয়ের প্রকৃত তথ্য প্রকাশের জন্য রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং এনবিআরকে নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, অর্থনীতির এই চার খাতে তথ্যের গরমিল নিয়ে অনেক দিন আলোচনা চলছে। তথ্য সংশোধের জন্য অর্থ উপদেষ্টার উদ্যোগ ঠিক আছে। এসব খাতের গরমিল তথ্যে অনেক ভুল বার্তা যাচ্ছে। সঠিক তথ্য না থাকলে অর্থনীতি ও নীতি নির্ধারণকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। ভুল তথ্য দিয়ে ভুল পলিসি হবে এটিই স্বাভাবিক। ফলে সঠিক তথ্য পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটি দ্রুত সংশোধন করা উচিত।
অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি যুগান্তরকে জানান-চাল, ডাল, মাছসহ খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত ১২০-১৩০টি পণ্যের দামের উঠানামার পরিবর্তন নিয়ে মূল্যস্ফীতি নির্ণয় করা হয়। এক্ষেত্রে বিবিএসের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন বাজারে পণ্যের দাম সঠিকভাবে সংগ্রহ না করলে গরমিল হবে মূল্যস্ফীতির হার নির্ণয়ে। তবে বিবিএসের পণ্যের মূল্য কম দেখানোর প্রবণতা থাকে বলে, রিপোর্টে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির চিত্র আসে না।
তিনি আরও বলেন, অর্থনীতিতে ধান, গম, মাছসহ খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত (নানা ধরনের শিল্প) উৎপাদনের তথ্যের ওপর নির্ভর করেই প্রণয়ন করা হয় জিডিপি। এক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে দায়িত্বে থাকা লোকজনের ভেতরে কৃষি উৎপাদন বেশি দেখানোর প্রবণতা কাজ করে। যে কারণে জিডিপির হার বেশি হয়। কারণ সংগৃহীত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকে না।
এদিকে সরকারের প্রকাশিত জিডিপির হারের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পূর্বাভাসের প্রতিবছরই অমিল থাকে। সাধারণত সরকারের লক্ষ্যমাত্রা সব সময় বেশি দেখা গেছে। চলতি অর্থবছরের জিডিপির হার নির্ধারণ করে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ধরা হলেও বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে ৪ শতাংশ হবে বলে প্রকাশ পেয়েছে। আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হলেও শেষ পর্যন্ত অর্জন হয় ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ, কিন্তু উন্নয়ন সহযোগীরা জিডিপি প্রবৃদ্ধির এ হারকে স্বীকার করছে না। তারা প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কম দেখাচ্ছে। সেখানে বিশ্বব্যাংক বলছে অর্জন হবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এ পতনোন্মুখ অবস্থায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি নির্ধারণের সনাতনী কৌশল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ জিডিপির মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনীতির আকার এবং শক্তি প্রকাশ করা হয়। বিশ্বব্যাপী এটাই অর্থনৈতিক সামর্থ্য বা শক্তি নির্ধারণের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং বহুল আচরিত পদ্ধতি। কিন্তু বর্তমানে যে পদ্ধতিতে জিডিপি নির্ধারণ করা হচ্ছে, তা অসঙ্গতিপূর্ণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অযৌক্তিকও বটে। কারণ এভাবে হিসাবকৃত জিডিপির মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে দেখা গেছে সরকারি হিসাবে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশ দেখানো হয়। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায়ও কম ছিল। কিন্তু এটা বাস্তবতার তুলনায় সঠিক চিত্র নয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ও খাদ্যবহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতি বিশ্লেষণে দেখতে পায় ওই একই সময়ে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি অনেক বেশি। একেকটি পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে ১৫, ২০ ও ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে। এদিকে বিদায়ি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) রপ্তানি আয়ের নথিপত্রের হিসাবের তুলনায় বাস্তবে প্রায় ১১ বিলিয়ন (১১০০ কোটি) মার্কিন ডলার কমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে প্রকৃত রপ্তানি আয় হয়েছে ৫ হাজার ৫২৮ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু বাস্তবে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি মার্কিন ডলার। বাস্তব হিসাবটি বের করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
একই গরমিল হিসাব পাওয়া গেছে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে। অর্থ বিভাগের হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ হয় চার লাখ ৮ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা, অপরদিকে এনবিআরের হিসাবে তিন লাখ ৮২ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। দুটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে রাজস্ব আয়ের হিসাবের ব্যবধান ২৫ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। একইভাবে দেখা গেছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরের হিসাবে রাজস্ব আদায়ের অঙ্ক তিন লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা এবং অর্থ বিভাগের হিসাবে তিন লাখ ৬৬ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এখানেও হিসাবের পার্থক্য ৩৫ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। অন্যান্য বছরের হিসাবে ব্যবধান অনেক।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক বাহবা নিতে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) হার এবং রপ্তানি আয়কে বেশি দেখানো এক ধরনের সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছিল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে। যে কারণে জিডিপির প্রকৃত হার নিয়ে বিগত সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দৃশ্যমান ছিল। একই ভাবে মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এছাড়া দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে প্রকাশ্যে চলে আসছে অর্থ বিভাগ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে দেশের মোট রাজস্ব আয়ের চিত্রে বড় ধরনের গরমিলের বিষয়টি। রাজস্ব আহরণ নিয়ে দুটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে বড় ধরনের ব্যবধান বিরাজমান আছে।