সাধারণ মানুষের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সেবাখাতে পরিকল্পিতভাবে দুর্ভোগ তৈরি করে মানুষের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক মনোভাব তৈরির চেষ্টা চলছে। পতিত সরকারের দোসর ও ফ্যাসিবাদের সমর্থিত লোকজন ঘাপটি মেরে বিভিন্ন স্তরে বসে থেকে এধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি খাতে বেসামাল জনদুর্ভোগ সৃষ্টির পর ভুক্তভোগীর মানুষের মুখ থেকে এসব কথা বেরিয়ে আসছে। তাদের ভাষ্য জনজীবনে পরিকল্পিত দুর্ভোগ তৈরি করে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে। দ্রুত এসব অসাধু চক্রকে নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে জনজীবনে আরো দুর্ভোগ বেড়ে যেতে পারে।
দ্রব্যমূল্য : আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর সাধারন মানুষের ধারণা ছিল বাজারের দ্রব্য নাগালে থাকবে। সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধ হবে। মানুষ বাজারের জিনিস পত্র সহনীয় পর্যায়ে কিনতে পারবে। কিন্ত বাস্তাবে বাজার মুল্য নিয়ন্ত্রনে নেই। মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। কেন জিনিসপত্রের দাম কমছে না তা নিয়ে চলে নানা ধরনের বিশ্লেষন। অনেকেই বলছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় রয়েছে।
তারাই মূলত বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে জনজীবনে দুর্ভোগ তৈরি করছে। যাতে করে সরকার সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। তবে আশার বাণী হলো দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে এবং দৈনন্দিন দরকারি পণ্যের দাম যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে সেজন্য বাজার তদারকি করতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স করেছে সরকার, যা ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন বাজারে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখা ও দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার কার্যকর মেকানিজম বা কৌশল না থাকার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এ সমস্যার ‘স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদি’ সমাধান টাস্কফোর্স দিয়ে সম্ভব হবে বলে মনে করেন না তারা।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকা যুগ্মসচিব মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম বলছেন, “সরকার এখন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এটাই এখন বড় সমস্যা। এর সমাধানে আরও পরিকল্পিতভাবে কাজ করতেই আমরা টাস্কফোর্সের প্রজ্ঞাপন জারি করেছি এবং তখন থেকেই এটা কার্যকর। এখন তারা (টাস্কফোর্স) নিজেরা বসে বাজার তদারকি করবেন।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভুঁইয়া বলেছেন, বাজার পরিস্থিতি দেখে তাদের কাছে মনে হয়েছে যে দাম বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। বর্ষা-বন্যার কারণে দাম হয়ত কিছুটা বাড়ত। কিন্তু যেভাবে বাড়ানো হয়েছে সেটা কারসাজি। আশা করছি টাস্কফোর্সের মনিটরিং শুরু হলে এর সুফল পাওয়া যাবে । যদিও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন বাজারের সংকট অনেক গভীর এবং ছোটখাটো যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে আপাতত কিছুটা লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে লাভ হবে না। টাস্কফোর্স যদি জেলা পর্যায়ে কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুত আছে সেই তথ্য নিতে পারে। এটা করে মজুত রেখে মুনাফার চেষ্টা কিছুটা কমতে পারে
গুজব উৎপাদন-প্রচারে সিআরআই এটিম : গুজব তৈরি করে জনমনে নানা ধরনের শংকা তৈরি করেছে একটি চক্র। এ চক্রের নেপথ্যে রয়েছে পতিত সরকারের দোসররা।
অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে জনমনে অনাস্থা সৃষ্টির লক্ষে কাজ করছে আওয়ামী লীগের অপপ্রচার সেলজানা গেছে, মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইনফ্লুয়েন্সার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও নানা সুবিধাভোগী গোষ্ঠী।
তবে গুজব উৎপাদন ও প্রচারের পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ মুহূর্তে দেশে-বিদেশে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় রয়েছে আওয়ামী লীগের অপপ্রচার কেন্দ্র ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন-সিআরআই’। সিআরআইয়ের চেয়ারম্যান শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং ভাইস চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এছাড়া হাসিনার ভাগন্নি আজমিনা সিদ্দিক এবং ভাগনে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এ প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি। আওয়ামী লীগের দুর্নীতি-দুঃশান, গুম-হত্যা-গণহত্যাসহ নানা অপকর্মকে বৈধতা দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা জায়গায় প্রয়োজনীয় প্রপাগান্ডা উৎপাদন করতে এ প্রতিষ্ঠান কাজ করে। এমনকি তারা গুজব সৃষ্টি ও প্রচারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট- এআই বা বট প্রযুক্তিও ব্যবহার করে থাকে।
সংঘবদ্ধভাবে মিথ্যা প্রচারণার কারণে এর আগে বাংলাদেশের ৫০টি ফেসবুক আইডি ও ৯৮টি পেজ বন্ধ করে দিয়েছিল ফেসবুক। এসব কর্মকা-ে সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও দলটির গবেষণা সিআরআই-এর সংশ্লিষ্টতা পেয়েছিল মেটা।
গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, অন্তবর্তী সরকার, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসহ অন্য উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে, গুজব রটিয়ে মানুষেকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন কি বিভিন্ন ইস্যু উৎপন্ন করে সামাজিক মাধ্যমে ভীতি ছড়িয়ে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে চলেছে এ গোষ্ঠীটি। সমন্বয়কদের ব্যাপারেও ছড়ানো হয় নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ’-এ
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে করা হয়েছে নানা অপপ্রচার। ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টার ব্যবহৃত একটি শব্দ- ‘রিসেট বাটন’ নিয়েও চলেছে অপব্যাখ্যা। ইউনুস পদত্যাগ করেছেন বলে গুজব ছড়ানো হয়। এমন গুজবও ছড়ানো হয় মঙ্গলবার গভীর রাত পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে। ফলে মঙ্গলবার সারা রাত কি ঘটছে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৈরি হয় ঔৎসুক্য, উত্তেজনা ও ভীতি। বুধবার সকালে এ নিয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে, সহিংসতা উসকে দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে তারা। তবে কোনো কিছু নিয়ে কেউ গুজব ছড়ালে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন র্যাবের মহাপরিচালক । তিনি বলেন, ‘মানুষকে গুজব থেকে বাঁচাতে সাইবার সেল মনিটরিং করছে। কেউ গুজব ছড়ালে ব্যবস্থা নেয়া হবে। চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি দুর্গা পূজায় কোনো বিশৃঙ্খলা হবে না। সুযোগ পাবে না দুষ্কৃতকারীরা। এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে সন্ত্রাসীদের।’ জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ চেষ্টায় এবারের পূজা সুন্দরভাবে।
পরিকল্পিত যানজট : হঠাৎ করে রাজধানীর প্রবেশ পথ ও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে যানজটে চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ যানজট পরিকল্পিত। মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ি হানিফ ফ্লাইওভার প্রবেশ পথ এবং টিকাটুলি থেকে গুলিস্তান ফ্লাইওভারে টোলপ্লাজ পর্যন্ত নিত্যদিন তীব্র যানজট দেখে দিয়েছে। ফলে এ সড়কে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় আটকা থাকতে হয় যাতায়াতকারীদের। এতে করে প্রতিদিনই চরম দুর্ভোগ পোহতে হয়। বিশেষ করে প্রতিদিন অফিস টাইমে যানজন তীব্র হওয়ায় অফিসগামী মানুষের দুর্ভোগের মাত্রা বেড়ে যায় কয়েকগুন। বাধ্য হয়ে পায়ে হেঁটে অফিসে রওয়ানা দিতে হচ্ছে অনেক চাকরিজীবিকে।
হঠাৎ করে কেন যানজট দেখা দিয়েছে এবিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, পরিকল্পিত ভাবে এ সড়কে যানজট তৈরী করছে। ভুক্তভোগীদের দাবী, পরিকল্পিতভাবে যানজট তৈরি হওয়ায় মানুষ যাতে চরম ক্ষুদ্ধ হয়ে সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়। বিশেষ করে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলাই পরিকল্পিত যানজট সৃষ্টির লক্ষ্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হানিফ ফ্লাইওভারের প্রবেশ পথে এলোপাথারি বাস রাখা হয়। যাতে করে মহাসড়কের বাস গুলো ফ্লাইওভাবে স্বাভাবিকভাবে উঠতে না পারে। এখানে একটি সড়ক ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলে গেছে ঐ সড়কের প্রবেশ পথে এলাপাথারি বাস রাখার কারনে পেছনে থাকা বাস গুলো সামনে অগ্রসর হতে পারে না।
ফলে যানজট তীব্র হতে থাকে। অবস্থা ভেদে যানজট মাতুয়াইল সাইনবোর্ড পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। ফ্লাইওভারের প্রবেশ পথে আগে ট্রাফিক ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে নেই। এমনকি আগে শনির আখড়া ট্রাফিক ব্যবস্থাও বন্ধ আছে। এছাড়া যাত্রাবাড়ি মোড়ে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনকারীরা চরম অবহেলার পরিচয় দিচ্ছে। মানুষ যখন যানজটের কবলে পড়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে ঠিক সে সময় তারা খোশ গল্পে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। এদিকে ফ্লাইওভারের উপর ক্রসিং সড়কের প্রবেশ পথ পরিকল্পিতভাবে এলোপাথারি বাস রাখার কারনে যানজট দেখা দিয়েছে। আগে এধরনে ঘটনা ঘটতো বলে ভুক্তভোগীরা দাবি করেন। একই সাথে হানিফ ফ্লাইওভাবের টিকাটুলি থেকে গুলিস্তান টোলপ্লাজা পর্যন্ত নিত্যদিন যানজট লেগেই থাকে। গুলিস্তান টোনপ্লাজা এলাকার দায়িত্বরত ট্রাফিকদের চরম অবহেলার কারনে প্রতিদিনই যানজট তৈরী হয়।
সরেজমিনে গতকাল সোমবার ঢাকার প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি দেখা গেছে। সকাল ৯টার আগেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা থেকে শনির আখড়া, রায়েরবাগ হয়ে মাতুয়াইল মেডিকেল এলাকা ছাড়িয়ে গেছে যানজট। যাত্রাবাড়ী থেকে মহাসড়কের ৫-৬ কিলোমিটারের বেশি এলাকা ছাড়িয়ে গেছে।
ট্রাফিক পুলিশ সক্রিয় না থাকায় এ যানজট বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, গত কিছুদিন ধরে এ মহাসড়কে প্রতিদিনই যানজট লাগছে। তীব্র যানজটে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন চলাচলকারী লাখ লাখ মানুষ।
ইন্টারনেটে ধীরগতি : সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ইন্টারনেট ব্যবহারের সমস্যা হচ্ছে। অনেক মোবাইল কোম্পানির সিম এ ইন্টারনেট ব্যবহারে সমস্যা হচ্ছে। তবে এসমস্যা সার্বজনীন নয়। বিভিন্ন স্থানে এটি হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, ইন্টারনেট সেবা নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে সেটা পরিকল্পিত। এর ফলে সেবা খাত নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করা এর লক্ষ্য।