খুলনা যশোর সাতক্ষীরার মানুষের দুঃখ হলো জলাবদ্ধতা। এই তিন জেলার ৮ উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে এখন চলছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। এক সময় উপকূলীয় অঞ্চলে অষ্টমাসী বাঁধ নির্মাণ করে ধানসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করতেন এলাকার কৃষক ও জমির মালিকরা। এরপর নিজেরা চার মাসের জন্য বাঁধ কেটে দিয়ে নদীর পানি প্লাবনভূমি ও খালগুলোতে প্রবেশ করতো। যে কারণে নদীর পলি মাটি কৃষি জমিতে পড়ে তা উর্বর ভূমিতে পরিণত হতো। কোনো প্রকার জৈব কিংবা রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু ’৬০-এর দশকে নেদারল্যান্ড সরকারের অর্থায়নে উপকূলীয় এলাকায় পোল্ডারের মাধ্যমে ওয়াপদার ভেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। ফলে জোয়ারে আসা পলি মাটি নদীগর্ভে পড়ে ভরাট হয়ে যেতে থাকে। তার সঙ্গে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব। উজানের পানির চাপ কমে যাওয়ায় নদ-নদীর ¯্রােত না থাকায় উপরের মিষ্টি পানির উৎস্য কমে যায় এবং জোয়ারের লবণ পানি আর পলি মাটি পড়ে নদীগুলো এখন মৃত প্রায়। বর্তমানে অনেক নদীর উপরের অংশ মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। মরে গেছে অনেক ছোট নদী ও খাল। যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ’৮০-এর দশকে শুরু হয় বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা।
বিল ডাকাতিয়ার ভবদহকে কেন্দ্র করে খুলনা জেলার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলা এবং যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার বিভিন্ন বিলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ওই সময় দাবি ওঠে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে জোয়ার-আঁধার (টিআরআম) এর মাধ্যমে পলি অপসারণ করলে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড আর দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সেখানে প্রকৃতি বিরুদ্ধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।
‘৯০-এর দশকের শুরুতে প্রায় ২২২ কোটি টাকার (কেজিডিআরপি) প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। তবে সেটি স্থায়ী সমাধান হয়নি। কিছু দিন যেতে না যেতেই আবারও পলি ভরাট হয়ে ভবদহ স্লুইস গেট বন্ধ হয়ে গেছে। ওই প্রকল্পটি যে ভুল ছিল, তা মানতে নারাজ পানি উন্নয়ন বোর্ড। তাদের দাবি, তখনকার বাস্তবতায় সেটি সঠিক ছিল। ওই প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে স্থানীয় পানি ব্যবস্থা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই পানি ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মকান্ড এখন বাস্তবে নেই। ফলে প্রকল্পের কিছু রিকমেন্ডশন ছিল, সেটি সচল না থাকায় এবং সময় মতো প্রকল্প পাশ ও অর্থের অভাবে বিল ডাকাতিয়া তার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। একই কারণে খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন স্থানে এখন নতুন করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত ১৫ বছরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেওয়া নদী খনন আর ভেড়িবাঁধ নির্মাণে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। সঠিক ভাবে কাজ হলে এ দুর্দশা হতো না।
ডুমুরিয়ার একটি নদী খননের কাজ করেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি শাহিন চাকলাদার। নামে মাত্র খনন করে সমুদয় বিল উঠিয়ে নেন। ওই সময় কোনো গণমাধ্যম কর্মী খনন কাজ এলাকায় যেতে পারেননি। এমনকি নদী খননের মাটি লুট করে নিয়ে যান, যশোর-৫ আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের কথিত এক ভাগ্নে। এভাবে অধিকাংশ প্রকল্পের আড়ালে হয়েছে সীমাহীন লুটপাট।
ডুমুরিয়া এলাকার পানি কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ এ বি এম শফিকুল ইসলাম বলেন, নদীতে পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে।
প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খায়িয়ে প্রকল্প গ্রহণ না করলে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে না। উদাহারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিল ডাকাতিয়ার প্রকল্প আজ ভেস্তে গেছে।
তিনি বলেন, উজান থেকে পানি আসছে না। আর নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। পানির উচ্চতা বাড়ছে। তাই এখন প্রয়োজন টিআরএম’র (জোয়ার-আঁধার) পদ্ধতির মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ করা। এতে নদীর নাব্যতা বাড়বে এবং পানি নিষ্কাশন সহজ হবে। খনন কাজ করে শুধু অর্থ নষ্ট হবে। কেন না, খননের পর আবার জোয়ারে আসা পলি মাটি ভরে যাবে। এভাবে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়া করা সম্ভব নয়। আবার প্রকল্প ব্যয়বহুল হবে, স্থায়ী হবে না। তিনি মনে করে, বর্তমান পরিবেশ বান্ধব সরকার স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ করে দক্ষিণের এই তিন জেলার মানুষকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
ডুমুরিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আল আমিন বলেন, আসলে ডুমুরিয়াসহ এ অঞ্চলে কেন এই জলাবদ্ধতা হচ্ছে, তার একটি বিস্তারিত গবেষণার দরকার। আগে পিছে কি হয়েছে, তার আলোকে আগামীতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ করা হলে এ সমস্যা দূর করা সম্ভব।
খুলনা অঞ্চলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা অতীতের প্রকল্পগুলো প্রকৃতি বিরুদ্ধে ছিল এটি মানতে নারাজ। তিনি বলেন, তখনকার সময়ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। সেটি তখনকার বিবেচনায় ঠিক ছিল। বিল ডাকাতিয়ার কেজিডিআরপি প্রকল্প প্রসঙ্গে তিনি জানান, ওই প্রকল্পের কিছু রিকমেন্ডশন ছিল। সেটি যথা সময় বাস্তবায়ন হয়নি। গঠিত পানি কমিটি কার্যত নিষ্ক্রীয়। তিনিও স্বীকার করেন, টিআরএম পদ্ধতি ভালো, তবে এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনসাধারণ ও জমির মালিকদের সহযোগিতা প্রয়োজন। বর্তমান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে গত সপ্তাহে একটি বৈঠক হয়েছে। বর্তমান পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান চলতি অক্টোবর মাসে খুলনায় আসতে পারেন। তিনি বিষয়টি অবগত আছেন এবং গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। বিদ্যুৎ কুমার সাহা আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করছি জাতীয় ও স্থানীয় স্টেক হোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণের। তিনি আরও বলেন, নদীতে পলি জমে ভরাট হওয়ার অন্যতম কারণ ফারাক্কার বাঁধের কারণে উজানের পানির চাপ কমে যাওয়া। তাই প্রাকৃতিক পদ্ধতি, লোকায়ত জ্ঞান আর আধুনিক টেকনোলজির সমন্বয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সেটি টেকসই হবে।