ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেক ফজলে নূর তাপস পালিয়েছেন গণঅভ্যূত্থানের আগেই। আর হাসিনা পারিয়েছেন খবর শুনেই ৫ আগস্ট বিকেলে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম পালিয়ে যান। দুই মেয়র সিটি কর্পোরেশনের অন্যান্য লুটের সঙ্গে মশা নিধনের শত কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন। ফলে নগরবাসী নিয়মিত সিটি কর্পোরেশনের ট্যাক্স দিলেও মশার যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না।
মূলত এডিস মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ট নগরবাসী। প্রতিদিন এ মশার কাপড়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। গতকালও তিন জন প্রাণ হারিয়েছেন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে। আর চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে মৃত্যু হয়েছে ১৯৯ জনের। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪০ হাজার ৪০৫ জন। দুই মেয়র পলাতক এবং তাদের সাসপেন্ট করা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ দুই মেয়র গেলেও এডিস মশা যায়নি। গত কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় রাজধানী ঢাকায় মশার ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু মশা নিধনের কোনো উদ্যোগ নেই।
জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, বৃষ্টিপাত হলেই মশার প্রজনন বাড়তে শুরু করে। কিন্তু মশা নিধনের নামে দুই সিটি কর্পোরেশন বিপুল অর্থ বরাদ্দ করলেও সে টাকা কার পেটে যায় বলা মুশকিল। কারণ মশা নিধনের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয় না।
নাগরিক সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১২ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা হয়। কিন্তু নাগরিক সেবা বৃদ্ধির বদলে গত কয়েক বছরে দুর্ভোগ বেড়েছে। এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে কেউ না কেউ। দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধণ কার্যক্রমের সাথে জরিত লোকজন যেন এখন মনোযোগী নয়। দুই করপোরেশন মশা মারার নামে বিপুল পরিমান টাকা বরাদ্দ রয়েছে এবং খরচও করছে। তারপরও দৃশ্যমান কোনো কাজ হচ্ছে না। দুই সিটি করপোরেশন গত হাসিনা সরকারের আমলে মশা মারতে হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় মশার উৎপাত কমেনি।
দুই সিটি করপোশেনের মশা মারতে কীটনাশক ক্রয়ের পাশাপাশি ড্রেনে তেলাপিয়া মাছ, গাপ্পি মাছ, হাঁস, ব্যাঙ অবমুক্ত করে মশক নিধনের এবং ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎসস্থল চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। মশা নিধনে প্রতি বছরেই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেও দৃশ্যমান কোনো উপকার পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু অর্থেরই অপচয় হচ্ছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনে কাজ করলেও নগরবাসী এই মশার কামড় থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। প্রতিদিনই এডিস মশার কামড়ে মৃত্যুবরণ করেছে অনেকে। হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা। এই রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। তেলাপিয়া মাছ, গাপ্পি মাছ, হাঁস, ব্যাঙ অবমুক্ত করে মশক নিধনের নামে খরচ করেছে কাড়ি কাড়ি টাকা। মশা মারার ওষুধ ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস সেরোটাইপ ইসরায়েলেন্সিস (বিটিআই) নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ ছিলো।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাজেটে মশা নিয়ন্ত্রণে মোট ১১৪ কোটি ৫০ লাখ বরাদ্দ রেখেছিলো। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশা মারতে ব্যয় নির্ধারণ করেছিলো ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা টাকা। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে এবার ৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করে। গত অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ব্যয় ছিল ৫২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই অর্থ বছরে এই খাতে বাড়ানো হয়েছে ৬১ শতাংশ। সব মিলিয়ে মশার সঙ্গে যুদ্ধে এই অর্থবছরে ১১৪ কোটি টাকা খরচ করে উত্তর সিটি করপোরেশন।
এখন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। কোনো ক্রমেই মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সংস্থা দুটি। ফলে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। চলতি অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। সিটি করপোরেশন তার নাগরিকদের যেসব সেবা দিয়ে থাকে, তার মধ্যে মশক নিধন অন্যতম কাজ। কিন্তু এ কাজটিই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ঠিকমতো করতে পারছে না এবং তারা এ কাজে ব্যর্থ বলে অভিযোগ করেন নাগরিকরা।
জুলাই মাসে সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬৬৯ জন, মৃত্যু হয় ১২ জনের। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে আক্রান্ত হয় ৪৭৩ জন, মৃত্যু হয় একজনের। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আক্রান্ত হয় ৬৭৬ জন, মৃত্যু হয় ছয়জনের। আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ৬ হাজার ৫২১ জন, মৃত্যু হয় ২৭ জনের। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে আক্রান্ত হয় ১ হাজার ৯২ জন, মৃত্যু হয় একজনের। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আক্রান্ত হয় ১ হাজার ৯০৯ জন, মৃত্যু হয় ১৭ জনের। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ১৮ হাজার ৯৭ জন, মৃত্যু হয় ৮০ জনের। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে আক্রান্ত হয় ৩ হাজার ৯৭৭ জন, মৃত্যু হয় ১৫ জনের। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আক্রান্ত হয় ৩ হাজার ৭৮৫ জন, মৃত্যু হয় ৩৮ জনের।
দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১৯৯ জনের মৃত্যু হলো। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫৮৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ২৪৬ জন এবং বাকিরা ঢাকার বাইরের। এ সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৫৬০ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪০ হাজার ৪০৫ জন। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৩৬ হাজার ৭১১ জন। ২০২৩ সালে দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী আক্রান্ত এবং ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়।
এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে নতুন করে আরো ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৬ জনে। এসময় নতুন করে এক হাজার ৩৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে আরও এক হাজার ৩৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এসময় মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। মৃতদের মধ্যে দুইজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এবং অন্যজন ঢাকা উত্তর সিটির বাসিন্দা। নতুন করে আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ৪২৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়াও ঢাকা বিভাগে ২০৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩১ জন, বরিশাল বিভাগে ৮৬ জন, খুলনা বিভাগে ৮০ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩২ জন, রাজশাহী বিভাগে ৫৯ জন, রংপুর বিভাগে ৭ জন এবং সিলেট বিভাগে ৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
১ জানুয়ারি থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪০ হাজার ৪০৫ জন। যার মধ্যে ৬৩ দশমিক ৩০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী। মৃত ১৯৬ জনের মধ্যে ৫০ শতাংশ নারী এবং ৫০ শতাংশ পুরুষ। প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গেল বছর দেশে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন, যার মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে দুই লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। ২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং প্রায় ৩০০ জন মারা গিয়েছিলেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কম ছিল, কিন্তু ২০২১ সালে ২৮ হাজার ৪২৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ১০৫ জন মারা যান। ২০২২ সালে ডেঙ্গুর জন্য মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, যার মধ্যে ২৮১ জন মারা গিয়েছিলেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, মুগদা এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি। প্রতিদিন এসব এলাকা থেকে শত শত মানুষ ডেঙ্গু চিকিৎসা নিতে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে যাচ্ছেন। মশা নিয়ন্ত্রণে ৭৫টি ওয়ার্ডে সারা বছরই নানা কর্মসূচি পালন করে তারা। এরই অংশ হিসেবে প্রতিদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। নিয়মিত করা হচ্ছে জরিমানা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দপ্তর সূত্র জানায়, আগে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা তৈরিতে সবচেয়ে বেশি প্রচারণা বা কর্মসূচি চালিয়েছে তারা। কিন্তু এবার সরকার পতনের পর তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শুধু গত ১৯-২৬ সেপ্টেম্বর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তারা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন বলেন, সপ্তাহব্যাপী পরিচালিত বিশেষ কার্যক্রমে এক লাখ ২১ হাজার ৮৮৬টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫১টি বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। এসব লার্ভা ধ্বংস করা হয়েছে। মশা নিধনে তাদের কোনো কার্যক্রমই থেমে নেই। মশা নিধনের সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়াতে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ, শোভাযাত্রা এবং বাড়ি বাড়ি এডিস মশার প্রজননস্থল অনুসন্ধানের কাজ চলছে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, মশার প্রজননস্থল ধ্বংস এবং নাগরিকদের সচেতন করা হচ্ছে। পাশাপাশি সকালে লার্ভিসাইডিং কার্যক্রম ও বিকেলে এডাল্টিসাইডিং কার্যক্রমও চলছে। মশক নিয়ন্ত্রণে দৈনন্দিন নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি সব ওয়ার্ডে ক্রমান্বয়ে বিশেষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধন কার্যক্রম তথা চিরুনি অভিযান চালানো হচ্ছে।