সবসময়ই সব ক্ষেত্রে বেপরোয়া মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। চরম বেপরোয়া ছিল তার দুর্নীতি-লুটপাট। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতিত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পলাতক সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের জন্য তাবৎ অনিয়ম-দুর্নীতিই ছিল তার ‘নীতি’। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দাপট দেখিয়ে একাধিক বিশ^বিদ্যালয় দখল ও যথেচ্ছ নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা বিভাগের টপ টু বটম নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যসহ নানা উপায়ে সীমাহীন আর্থিক দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে নওফেলের বিরুদ্ধে বিস্তর। নওফেলের নিয়োজিত দালালদের মাধ্যমে শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন সেক্টর থেকে ঘুষ-দুর্নীতির কাড়ি কাড়ি টাকা উড়ে আসতো তার হাতের মুঠোয়।
দুর্নীতি, লুটপাটের মাধ্যমে অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়েছেন নওফেল। তার অর্থ-সম্পদ বেড়ে হয়েছে কমপক্ষে দশগুণ। নওফেলের আঙুল ফুলে হয়েছে বটগাছ! নওফেলের এসব দুর্নীতি-অনিয়ম ও লুটপাটের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং অন্যান্য গোয়েন্দা ও তদন্ত সংস্থা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ও সংশ্লিষ্ট বিভাগে দুর্নীতি-হরিলুটে সাবেক মন্ত্রী নওফেলের সহযোগী ও বরকন্দাজদের অপককর্মেরও তদন্ত চলছে। এ কারণে ওরা এখন তটস্থ। নওফেল ও তার সহযোগী দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে দেশের শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট মহল থেকে। পতিত আওয়ামী স্বৈরশাসকের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বিরুদ্ধে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে দুর্নীতি-অনিয়ম, লুটপাটের মাধ্যমে তার পাহাড়সম অবৈধ অর্থ-সম্পদ অর্জনের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মবহির্ভূত উপায়ে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ ও কব্জায় নেয়া, কাড়ি কাড়ি টাকার বিনিময়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও বদলির ঘটনা।
নওফেলের দেয়া নির্বাচনী হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের পর থেকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য (এমপি) প্রার্থী হওয়া পর্যন্ত সাবেক এই শিক্ষা উপমন্ত্রী ও তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নওফেলের আগের পাঁচ বছরে তার অর্থ-সম্পদ বেড়েছে সাত গুণ। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা মতে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী দুঃশাসনের পতন পর্যন্ত পরবর্তী সময়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও এমপি’র অর্থ-সম্পদের পাহাড় বেড়ে হয়েছে কমপক্ষে দশগুণ।
নওফেল দুর্নীতি-অনিয়ম, লুটপাটে পরদর্শী হলেও প্রথমে শিক্ষা উপমন্ত্রী, এমপি এবং পরের টার্মে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে ছিলেন পুরোপুরি ব্যর্থ প্রমাণিত। বরং তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বনাশ ঘটিয়ে গেছেন। যার রেশ এখনও শেষ হয়নি। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) এবং চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের যথেচ্ছ দখল ও নিয়ন্ত্রণে নেন নওফেল। সেখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ থেকে টেন্ডার বাণিজ্যও ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। আর চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে নিজস্ব ক্যাডার ও চাঁদাবাজ বাহিনী দিয়ে যথেচ্ছ নিয়ন্ত্রণ, লুটপাট চালান। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন দুই ভিসি ছিলেন নওফেলের দুর্নীতি-লুটপাটের সহযোগী।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী ছিপাতলী মাদরাসায়ও জনৈক বিতর্কিত প্রিন্সিপালকে দিয়ে পরগাছা, বরকন্দাজ, দুর্নীতি ও লুটেরা সহযোগী গোষ্ঠি তৈরির অপচেষ্টা চালিয়ে শেষমেশ ফেল হন নওফেল। চট্টগ্রামে ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন নওফেল।
অনেকগুলো অভিযোগ রয়েছে, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী থাকাকালে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগের এই সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রী হয়ে তার দুর্নীতি-লুটপাট আরও বহুদূর বিস্তার লাভ করে। তার অবৈধ সম্পদ ও দুর্নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করেছে। গত ২০ আগস্ট বিএফআইইউ নওফেল এবং তার পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত এবং ব্যাংক হিসাবের তথ্যও তলব করেছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থী ও জনতার ওপর হামলা এবং একাধিক হত্যাকা-ের নির্দেশদাতা হুকুমের আসামি হিসেবে কমপক্ষে এক ডজন মামলার আসামি হয়েছেন নওফেল। চট্টগ্রামে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণকারী সশস্ত্র আওয়ামী ক্যাডারদের বেশির ভাগই তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া-চকবাজার) আসনে টানা দুইবার বিনা ভোটের এমপি নওফেলের এখনও কোন খোঁজ মিলেনি। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের দিন থেকেই তিনি পলাতক। কেউ কেউ বলছে, নওফেল পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। কেউ বলছে দেশের ভেতরে কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি তিনি এখন কোথায়। প্রসঙ্গত নওফেল ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশোনা করেছিলেন বলে ‘ইসকন’সহ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সগর্বে বলতেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রথমে উপমন্ত্রী এবং এরপর মন্ত্রী থাকাকালে ব্যাপক বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে নওফেলের বিরুদ্ধে। এর মাধ্যমে প্রতিটি নিয়োগ-বদলি সুপারিশের জন্য লাখ লাখ টাকা পকেটে ভরেছেন। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণও নিজের কব্জায় নেন তিনি। বোর্ডের কেনাকাটার সব কাজ পেতেন তার সহযোগী ঠিকাদাররা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সিভাসুর শিক্ষক নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে নিজের পছন্দের লোকজনকে নিয়োগ দিতেন তিনি। এ ছাড়া রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্যও সুপারিশ করেন নওফেল।
এসবের মধ্যদিয়ে নওফেল কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। মহিবুল হাসান নওফেল নিজ ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজস্ব বলেয়ের লোকদের নিয়োগ দিতেন। মেধাবীরা ছিলেন বঞ্চিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও সিভাসুকে দুর্নীতির হাটে পরিণত করেন তিনি।
কলেজ শিক্ষকদের বদলির ক্ষেত্রে নওফেল তার পিএস এবং নিজস্ব দালালদের মাধ্যমে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা ঘুষ নিতেন। এ ছাড়া লাখ লাখ টাকার লেনদেনে বিভিন্ন কলেজে প্রিন্সিপাল নিয়োগ করা হতো। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ-পরিদর্শকসহ বিভিন্ন পদে নিজের লোকদের নিয়োগ দিতেন নওফেল। তারা ফলাফল জালিয়াতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপকর্ম করলেও শিক্ষামন্ত্রী সব সময় নীরব ছিলেন। নওফেলের বশংবদ শিক্ষা বিভাগ ও বোর্ডর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তার জন্য খামে ভরে টাকা পাঠাতেন। নওফেলের নিয়োজিত দালালদের মাধ্যমেও কাড়ি কাড়ি অর্থ আদায় হতো।