গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আগে ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শিশু, কিশোর, শিক্ষার্থী, নারীসহ হাজারো মুক্তিকামী মানুষ। সফল গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের আহ্বানে নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এমন সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের দায়িত্ব পায়, যখন ভোট বিহীন দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যায়। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরেই রাষ্ট্র সংস্কারের স্বপ্ন বুনছে দেশের সাধারণ মানুষ। শুরু থেকে অশ্চিয়তা ও দোলাচলের পর নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গতকাল ৮ অক্টোবর মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকার তাদের দুই মাস পূর্ণ করেছে। এই সময়ের মধ্যে অনেক বিষয়ে বিচক্ষণতার সঙ্গে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে করে সরকারের প্রতি গণলমানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে দেরিতে সংষ্কারের উদ্যোগ নেয়ায় হতাশাও তৈরি হয়েছে। তারপরও এই সরকারের উপরই আস্থা-বিশ^াস রাখছে সাধারণ মানুষসহ রাজনৈতিক দলগুলো।
সূত্রমতে, ক্ষমতা গ্রহণের পর গত দুই মাসে প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদল করেছে সরকার, যা এখনও চলমান আছে। তবে এই রদবদলে তাদের ব্যাপক ষড়যন্ত্র ও বিরোধীতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আর্থিকখাতসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে সংস্কার উদ্যোগ। স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করে তাদের জায়গায় বসানো হয়েছে প্রশাসক। যদিও উপজেলাসহ কিছু জায়গায় এখনো ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজন বহাল তবিয়তে রয়েছে। ব্যাংকখাত সংস্কারে সিদ্ধান্ত হয়েছে আলাদা কমিশন গঠনের। সেই সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে অনিয়ম-জালিয়াতির মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার। এদিকে কর্মবিরতি ও হামলার ভয় কাটিয়ে আবারও মাঠে ফিরেছে পুলিশ। বাজার তদারকিতে করা হয়েছে ট্রাস্কফোর্স কমিটি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. এম হুমায়ুন কবির বলেন, দুই মাস খুব বেশি সময় নয়। গত ১৫ বছরে আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গত জুলাই-আগস্টে যে নৃশংসতা দেখেছি, সে প্রেক্ষাপটে দুই মাসে এই সরকারকে বেশ ইতিবাচক অবস্থানেই রাখব। এটা স্বাভাবিক সময়ের দুই মাস নয়। ধ্বংসস্তূপ থেকে দাঁড়ানোটাই ছিল এই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
দুই মাস সময়টা খুবই অল্প, কাউকে মূল্যায়নের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। তারপরও এই সময়ে এই সরকার কী করেছে না করেছে তার দিকে নজর রয়েছে সবার। নজর রাখছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থাও। জানা গেছে, ড. ইউনূস দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ব পরিম-লে তার যে পরিচিতি ও সুনাম রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে তার ডাকে সাড়া দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, পাকিস্তানসহ বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বহু দেশ। সরকার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্র ও প্রশাসন মেরামতে এরই মধ্যে ৬টি কমিশন গঠন করেছে।
দুই মাসে বড় কিছু পদক্ষেপ নিয়ে সরকার তার সক্ষমতা প্রমাণ করলেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় সাধারণ মানুষ কিছুটা হতাশায় রয়েছেন। যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানিয়েছেন, অনেক পণ্য ডিউটি ফ্রি করার পরও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। এজন্য বাজার মনিটরিংয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই তারা মাঠে নামবে।
শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ভালোভাবে কাজ করছিল না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কিছুটা কঠোর হওয়ায় এখন কাজ করছে। তবে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামানোর পর পরিস্থিতি দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে।
দুই মাসেও শৃঙ্খলা ফেরেনি নতুন সরকারের প্রশাসনে। অস্থিরতা ও বিতর্কও পিছু হটছে না। বিশেষ করে ডিসি নিয়োগ নিয়ে নানা মহা কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার পেছনে শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট আমলাদের মদদ রয়েছে বলে ধারণা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সরকারও নড়েচড়ে বসেছে। বিগত সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোও স্বোচ্চার। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ সবাই একযোগে বলছে, পতিত আওয়ামী সরকারের সময় সরকারের র্শীর্ষ পদে থাকা আমলাদের সরাতে হবে। তা না হলে অন্তর্বর্তী সরকার কিছুই করতে পারবে না।
প্রশাসনের অবস্থা জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, প্রশাসনে এখন যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, শিগগিরই সেটি কেটে গিয়ে কাজেও গতি ফিরবে। দলীয়করণের কারণে প্রশাসনে যে বড় ক্ষতি হয়েছে, সরকার তা কাটিয়ে উঠে পুনরায় নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, এই দুই মাসে কুটনীতিতে সফল এই সরকার। জাতিসংঘের সব প্রথা ভেঙে দিয়ে সাধারণ অধিবেশন চলাকালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ড. ইউনূসের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বাইডেনের বৈঠকের পর বিশ্বের অন্যান্য প্রভাবশালী দেশগুলোও ইউনূসের প্রতি তাদের সমর্থন ও সহযোগিতার কথা জানিয়েছেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশে সংগঠিত বর্বরোচিত গণহত্যার কথা শুনেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধানরাও বাংলাদেশের উন্নয়নে তাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. এম হুমায়ুন কবির বলেন, ভারত ছাড়া বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উন্নয়নের জায়গাতে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। এটার অন্যতম কারণ বাংলাদেশের এই পরিবর্তন পুরো বিশ্ব ইতিবাচকভাবে দেখছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের একমাস পূর্তিতে ছয়টি কমিশন গঠন করার কথা জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য। সংস্কারের মাধ্যমে জাতি হিসেবে নতুন যাত্রা শুরু করতে চায় তার সরকার। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, নির্বাচনের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠতার একাধিপত্য ও দুঃশাসন মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বা এর মাধ্যমে এক ব্যক্তি বা পরিবার বা কোনো গোষ্ঠীর কাছে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত চারটি প্রতিষ্ঠান সংস্কার করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচার প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন। এসব কমিশনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সমর্থনের কথা জানিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাসে সবচেয়ে বেশি সংস্কার হয়েছে আর্থিক খাতে। রিজার্ভ বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ বেশ কয়েকটি দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে ঋণের আশ্বাস পেয়েছে বাংলাদেশ। সরকার পরিবর্তনের পর রেমিট্যান্সও অব্যাহতভাবে বাড়ছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বর দুই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৬২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। গত বছরের একই সময়ে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২৯৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আর সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। অক্টোবরে সেই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গবর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গবর্নর হিসেবে আহসান এইচ মনসুর ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছেন।
সরকারের দুই মাসে বাংলাদেশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ প্রায় সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গার বৈঠকে বাংলাদেশকে সংস্কারে খরচের জন্য সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে আইএমএফ। এর পরও সংস্থাটি আরও ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চায়। আগামী তিন বছরে একটা প্যাকেজের আওতায় বাংলাদেশকে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেবে আইএসডিবি। এ ছাড়া ডিসেম্বরের মধ্যে বাজেট সহায়তা হিসেবে বাংলাদেশকে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেবে এডিবি। সংস্থাটি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি খাতে সংস্কারের জন্য দেবে ৫০ কোটি ডলার। এটা পাওয়া যাবে ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে। এর বাইরে জ্বালানি খাতের উন্নয়নেও এডিবির কাছে ১০০ কোটি ডলার চেয়েছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ১ হাজার ৩৬০ কোটি বা সাড়ে ১৩ বিলিয়নের বেশি ঋণ সহায়তা পাওয়ার আশ্বাস পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, দেশের আর্থিক খাতের অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। বিগত সরকারের সময়ে লাখ লাখ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। এমন বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ফেরাতে যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, সেগুলো অবশ্যই ইতিবাচক।
আনুষ্ঠানিকভাবে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। গত ২৯ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেন। সরকারের এমন পদক্ষেপ নাগরিকদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক মাইলফলক।
দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে প্রশাসনিক দক্ষতা ও একাডেমিক যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বরেণ্য শিক্ষাবিদদের ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেও একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদকে চেয়ারম্যান পদে বসিয়েছে সরকার। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে সরকার কোনো আপস করবে না বলে বিভিন্ন ফোরামে তারা বলছে।
শিক্ষা খাতে সরকারের কার্যক্রম স্বাভাবিক। এর মধ্যে পাঠ্যবই পরিমার্জন কমিটি বাতিল করা হয়েছে। স্কুলগুলোয় স্থগিত অর্ধবার্ষিকীর বাকি মূল্যায়ন এবং এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া মাধ্যমিকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ বিভাজন চালু করা এবং সর্বশেষ চলতি বছরের বার্ষিক পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন এবং সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ১৩ দিনের মাথায় বাতিল করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল করা হয় প্রথম এক মাসের মধ্যেই। একইসঙ্গে সমস্যা জর্জরিত ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়। এছাড়া, সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল স্টেশন নতুনভাবে ফের চালু করার বিষয়টি ছিল প্রশংসনীয়।
পুঁজিবাজারের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালী করতে গঠন করা হয় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কালাকানুন (দেশবাসীদের অমঙ্গলকারী আইন) বাতিল করার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। বিচার বিভাগে আগের নিয়োগ বাতিল করে সারা দেশে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ২২৭ জন আইনজীবীকে নতুন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের ৬৬ আইনজীবীকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ১৬১ আইনজীবীকে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, দুর্নীতি, হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানান অভিযোগ থাকার পরও গত দেড় দশকে যাদের বিরুদ্ধে সেভাবে আইনি ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি, আগের সরকারের সেইসব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এই দুই মাসের মধ্যে মামলা হতে দেখা গেছে।
সাধারণ মানুষ বলছেন, জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য এই সরকারকে কিছু দৃঢ় ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। অসফল হওয়ার মানেই হচ্ছে এত শত মানুষের রক্ত ও ত্যাগে অর্জিত এ অভ্যুত্থানের ব্যর্থতা, যা কারও কাম্য হতে পারে না। তাই দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এই সরকারকে সফল হওয়া জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অর্থনীতিতে গতি আনতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো ভালো। এই অল্প সময়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুফল আসা শুরু হয়েছে। তবে আরও কিছু সময় লাগবে।
জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে পণ্য রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে। এর মধ্যে জুলাইয়ে প্রায় ৩ শতাংশ ও আগস্টে প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ বেড়েছে রপ্তানি। এ দুই মাসে মোট ৭৮৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩২ কোটি ডলার বেশি। ছাত্র আন্দোলনের সময় গত জুলাইয়ে দেশে মূল্যস্ফীতি হয় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ছিল গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরের দুই মাসে তা কিছুটা কমেছে। এর মধ্যে আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ ছিল।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে পুলিশের আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ দেশে স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জননিরাপত্তা বিঘœকারী যে কোনো কর্মকান্ডের মাধ্যমে কেউ দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপচেষ্টা করলে পুলিশ অপরাধীকে গ্রেপ্তারসহ তাৎক্ষণিক আইনিব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অপরাধ দমনে পুলিশের সব ইউনিট প্রতিনিয়ত কাজ করছে।
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ওপরের দিকেই বাংলাদেশের অবস্থান। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দল, সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে তারা বিরোধীদল, নি¤œসারির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। জানা গেছে, আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে প্রায় ৯০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলেও এখনও উল্লেখযোগ্য কারও বিরুদ্ধে মামলার খবর পাওয়া যায়নি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদক পুনর্গঠনের প্রয়োজন। অতীতে যারা আইনের রক্ষক হওয়ার কথা ছিল তারা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
দীর্ঘদিন থেকে সংবিধান সংস্কারের দাবি ছিল। এই সরকার নয় সদস্যের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ চেইন তদারক এবং পর্যালোচনার জন্য জেলা পর্যায়ে ‘বিশেষ টাস্কফোর্স’ গঠন করেছে সরকার।
সরকারের দুই মাসের কার্যক্রম নিয়ে দলগুলোর মধ্যেও আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার, নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা, প্রশাসন নিরপেক্ষকরণ, নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার করা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে যথেষ্ট অস্পষ্টতা ও ধীরগতি রয়েছে বলে মনে করে বিএনপি’র সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি। এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন দলটির নেতারা। সর্বশেষ সরকারের সঙ্গে সংলাপে বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের কিছু দুর্বলতার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি তা কাটিয়ে উঠতে পরামর্শও দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সংলাপে জামায়াতে ইসলামীও কিছু পরামর্শ দিয়েছে সরকারকে। অন্যান্য দলের পক্ষ থেকে যেসব পরামর্শ এসেছে তা পর্যালোচনা করে বাস্তবায়ন করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, এক থেকে দুই মাস ব্যক্তি জীবনে অনেক হলেও একটি রাষ্ট্র বা সরকারের জন্য যথেষ্ট নয়।
এদিকে নতুন সরকার যখন দেশ সংষ্কারে ব্যস্ত তখন যত্রতত্র বিভিন্ন দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়ছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। যার কারণে অস্থিরতা রয়েছে রাষ্ট্রে। অনেকে সরকারকে অস্থিরতায় ফেলতে এমন করছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায় একটি গোষ্ঠী। অস্থিরতা কাটেনি পাহাড়েও। সেখানেও বিভিন্ন সহিংসতায় কারও কারও উস্কানি রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়াও অস্থিরতা রয়েছে পোশাকখাতেও। এখনো পোশাকখাতে শৃঙ্খলা ফেরানো যায়নি। বিক্ষোভে বন্ধ রয়েছে অসংখ্য পোশাক কারখানা। যার কারণে এ খাতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে।
জাময়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, সরকারের আরো দ্রুত এগোনো দরকার। সংস্কারের ধাপ অতিক্রম করেই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা দরকার।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গত দুই মাসে তাদের কাছে দেশের মানুষের যে প্রত্যাশা, তা পুরণ করতে পারেনি। তাদের কাজের গতিতে আমরা মোটেই সন্তুষ্ট নই।