দেশে বিদ্যুতের চাহিদার চেয়ে দ্বিগুণ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হলেও তা পুরাপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বন্ধ রাখতে হচ্ছে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। আবার বর্তমান জ্বালানিসংকটে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না ওই উৎপাদন সক্ষমতা। কিন্তু উৎপাদন হোক বা না হোক, চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই দিতে হচ্ছে।
এতে লোকসান বাড়ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি)।
প্রতিবছর ভর্তুকি দিয়ে বিশাল এই ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে সরকারকে, যা দেশের অর্থনীতির মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভর্তুকির চাপ কমাতে দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। এ ক্ষেত্রে ভোক্তাদের সহ্যসীমা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ এই তিন অর্থবছরে বিপিডিবির লোকসান গুনেছে প্রায় এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। এই সময়ে ঘাটতি পূরণে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে প্রায় এক লাখ সাত হাজার কোটি টাকা। বিপিডিবির হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছর বিপিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে (প্রাক্কলিত) ৪৭ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। এই সময় বিপিডিবিকে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৩৮ হাজার ২৮৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিডিবি লোকসান হয় ৫১ হাজার ৩০০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর বিপিডিবির লোকসান হয়েছিল ৩২ হাজার ৮৯১ কোটি ১৭ লাখ টাকা এবং ভর্তুকি দেওয়া হয় ২৯ হাজার ৬৫৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিবছরই বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির ব্যবহারও বাড়ছে। নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে, ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণও বাড়ছে।
এদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় অবমূল্যায়ন হয়েছে। গ্যাসের ব্যবহার কমে কয়লা ও জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। মূলত এসব কারণেই বিপিডিবির ব্যয় বেড়েছে। কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে এবং বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দিয়েও লোকসান সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।’
ইজাজ হোসেনের পরামর্শ, ‘ব্যয়বহুল তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে হবে। কারণ তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় ২০ টাকার বেশি। তাই মোট সক্ষমতার ১০ শতাংশের বেশি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকা উচিত নয়। এগুলো শুধু রাতের পিক আওয়ারে ব্যবহার করা যেতে পারে।’
বিপিডিবির তথ্য, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট। দৈনিক গড়ে উৎপাদন হয় ১৩ হাজার থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট।
সিপিডিবির গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বিদ্যুৎকেন্দ্রের অতিরিক্ত সক্ষমতা নিয়ে সম্প্রতি এক প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বলেন, ‘ব্যবহার করা না গেলেও কেন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে? আওয়ামী লীগ সরকার যে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করেছে, তা ২০৩০ সালেও প্রয়োজন হবে না। ছয় বছর পর চাহিদা দাঁড়াতে পারে ১৯ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। ২৫ শতাংশ রিজার্ভ ধরলে তখন ২৩ হাজার ২৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সক্ষমতা হলেই চলবে। অতিরিক্ত সক্ষমতার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি দিতে হচ্ছে।’
আওয়ামী সরকার ২০১০ সালে দুই বছরের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান)’ নামে একটি আইন করেছিল। পরে তিন দফায় ওই আইনের মেয়াদ ১৪ বছর বাড়ানো হয়। গত ১৪ বছরে বেসরকারি খাতে শতাধিকের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। সব বিদ্যুৎকেন্দ্রকেই কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসংক্রান্ত বিশেষ আইনে অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১০ সাল থেকে অনুমোদন দেওয়া ছোট-বড় এসব কেন্দ্রের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো দায়মুক্তি আইন পাস করে বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখে সরকার।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির বিশেষ বিধান আইনের অধীনে চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিশেষ বিধানের আওতায় করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গঠিত জাতীয় কমিটি জনগণের কাছে দুর্নীতির তথ্য চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। একই সঙ্গে ভারতের আদানি, বাংলাদেশের সামিটসহ ১১ প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ সরবরাহ-সংক্রান্ত চুক্তি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ জন্য এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কিত সব নথিপত্র তলব করেছে সরকার গঠিত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনে সম্পাদিত চুক্তি পর্যালোচনা করা হবে। এ জন্য বিদ্যুৎ ভবনে অনুষ্ঠিত গত ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় পর্যালোচনা কমিটির দ্বিতীয় সভায় ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রেরসংশ্লিষ্ট নথি ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর রয়েছে সামিট গ্রুপের মেঘনাঘাট ৫৮৩ মেগাওয়াট ও কড্ডা ৩০০ মেগাওয়াট, প্যারামাউন্ট গ্রুপের বাঘাবাড়ী ২০০ মেগাওয়াট, সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজের পটুয়াখালীর ১৫০ মেগাওয়াট, ওরিয়ন গ্রুপের মোংলা ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র, ইয়ুথ গ্রুপের মিডল্যান্ড পাওয়ার কম্পানির আশুগঞ্জ ১৫০ মেগাওয়াট, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকীর ডরিন পাওয়ারের মানিকগঞ্জ ১৬২ মেগাওয়াট, বেক্সিমকো গ্রুপের সুন্দরগঞ্জ ২০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র, ইন্ট্রাকো গ্রুপের লালমনিরহাট ৩০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র, এইচডিএফসি সিনপাওয়ারের সুতিয়াখালী ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র ও ভারতের আদানি গ্রুপের ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র।
https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/10/09/1433329