প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর তৃতীয় দফা সংলাপে সংস্কার এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা ঐক্যমতের দিকেই এগুচ্ছে। তাদের আলোচনাগুলো বিশ্লেষণ করলে এমনটাই আভাস মিলে। সবগুলো দলের সঙ্গে সংলাপ শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশগুলো আমরা একত্রিত করে দেখবো। রাজনৈতিক দলগুলো এই সরকারকে নিজেদের সরকার মনে করে। তারা এই সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়ার কথা জানিয়েছেন। মূলত দেখবো সবার সমঝোতার ভিত্তিতে যদি ঐক্যমত পাওয়া যায় তাহলে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাবে।
তৃতীয় দফার আলোচনায় রাজনৈতিকদলগুলোর সঙ্গে আলোচ্য বিষয় ছিল, ৬ কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে। এবিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা মনোভাব জানিয়েছেন প্রেস সচিব। তিনি বলেছেন প্রয়োজনে আরও অনেকগুলো সংস্কার কমিশন হবে বলে বলেছেন প্রফেসর ড. ইউনূস। মোটামুটি সবগুলো দলের দাবি ছিল যে, দেশে ফ্যাসীবাদ যেন ফিরে না আসে। সেই দাবির প্রতিধ্বনি করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানান, প্রশাসনে যারা ফ্যাসীবাদরে দোসর রয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। এদের অনেকেই গ্রেফতার হচ্ছেন এবং দোষীরা সবাই গ্রেফতার হবে বলেও আশস্থ করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী। তিনি বলেন, বিচার কার্যক্রম চলমান। গুম কমিশন হয়েছে। আয়না ঘর বানানোর অপরাধে বিচার হবে।
জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মহাসচিব সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে বলেছেন নির্বাচনই তাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি। তবে নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে তারা সরকারের কাছে কোনও মাস বা দিনকালের কথা বলেননি। তবে আলোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে নির্বাচন–সম্পর্কিত। কবে নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে একটি রোডম্যাপ দিতে বলেছি।
সেইসাথে সংস্কারের ব্যাপারেও বিরোধীতা করেননি তারা। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। তারা চান না অন্তর্র্বতী সরকার ব্যর্থ হোক। সেজন্য দ্রুতই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। বিএনপি বলেছে জরুরি সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে এগিয়েই যাওয়াই এখন সরকারের একমাত্র কাজ।
সংলাপ শেষে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমাদের দেওয়া দু’টি রোডম্যাপের মধ্যে একটি হবে সংস্কারের, আরেকটি নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলেই নির্বাচন সফল হবে। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ ও ভালো নির্বাচনের জন্য সরকারকে তারা যৌক্তিক সময় দিতে চান। কিন্তু সেই যৌক্তিক সময় কতদিন হতে পারে সেটি তারা ৯ অক্টোবর প্রকাশ করবেন। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে নির্বাচন সম্পন্ন করাই তাদের দায়িত্ব। তবে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সেটা হতে হবে। এজন্য একটি রোডম্যাপ হতে পারে সংলাপ কতদিনে শেষ হবে, আরেকটি হতে পারে নির্বাচন নিয়ে। ওদিকে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও অন্য যেসব দল সংলাপেও সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচনে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।
৬টি সংস্কার কমিশনের সাথে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে আরো ৯টি সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। তা হলো- আইন বিষয়ক সংস্কার কমিশন, নাগরিক সেবা বিষয়ক সংস্কার কমিশন, পররাষ্ট্র বিষয়ক সংস্কার কমিশন, শিক্ষা বিষয়ক সংস্কার কমিশন, বাকস্বাধীনতা বিষয়ক সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশন, শ্রমজীবী বিষয়ক সংস্কার কমিশন, সংখ্যালঘু ও নৃগোষ্ঠী বিষয়ক সংস্কার কমিশন, এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক সংস্কার কমিশন। এব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার কমিশন বৃদ্ধি করার পক্ষে। তিনি বলেছেন সংস্কারের জন্য আরও অনেক কমিশন হবে।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, আমরা বলেছি যে শিক্ষা কমিশন (কমিটি) বাতিল করা হয়েছে, এখন আরও একটি শিক্ষা কমিশন (কমিটি) গত ৩০ সেপ্টেম্বর গঠন করা হয়েছে প্রাথমিক ও উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয়ে। সেক্ষেত্রে কিছু আপত্তির জায়গা রয়েছে। এই কমিশনে এমন ব্যক্তি রয়েছে যারা বিগত সরকারের হয়ে কাজ করেছেন। এখানে আমাদের প্রধান উপদেষ্টার বিপক্ষে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন, এমন ব্যক্তিও রয়েছেন। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা যাতে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সেটা বলেছি। খেলাফত মজলিসের মহাসচিব বলেন, প্রতিটি কমিশন আলাদা আলাদা করে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করবে। আলোচনার মাধ্যমে তারা তাদের সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করবেন। সেই প্রস্তাবনা তৈরি হলে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবেন। তারপরেই সবার মতামত নিয়ে সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ শুরু করার কথা বলেছি।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ন্যূনতম ঐক্যের চেষ্টা তাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) করতে হবে। ভালো নির্বাচনের জন্য আমাদের সংস্কার প্রয়োজন। যত দূর পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য করতে পারব, তত দূর সংস্কার করতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে প্রস্তাবগুলো তুলে ধরা হয়। এরমধ্যে প্রথম দাবি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের পরিকল্পনা ও রোডম্যাপ প্রকাশ করা। আগামী নির্বাচন করতে যেসব মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন, তা শেষ করে দেড়-দুই বছরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সব সংস্কার করার দায়িত্ব এই সরকারের না। তবে এর মধ্যে প্রধান হবে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচন কবে হবে সেই রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
সংলাপ শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘রিফর্মের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একটা ন্যূনতম ঐকমত্যে আসবে। ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে টাইমলাইন।’ একইসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘নির্বাচনি কাজগুলো এগিয়ে যাবে, নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজগুলো এগিয়ে যাবে। কারণ যখন ঐকমত্যটা রিফর্মের ব্যাপারে রিচ হলো, যাতে খুব দ্রুত নির্বাচনটা দিয়ে দেওয়া যায়।
নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ‘নির্বাচনি রোডম্যাপের ব্যাপারে যে আলাপটা হচ্ছে, ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, তার পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়েছে। বাকিটা দুই-একদিনের মধ্যে ঘোষণা হবে।
তিনি বলেন, ‘ছয়টি কমিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে কথা বলবে, তাদের তিন মাসের টাইমলাইনের মধ্যে। এরপর তিন মাসের মধ্যে একটা রিপোর্ট দেবে। প্রতিবেদনগুলো নিয়ে আবার উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। এরপর রিফর্মের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা ন্যূনতম ঐকমত্যে আসবে। ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে টাইমলাইন। কারণ কতটুকু রিফর্ম লাগবে সেটা দেখার বিষয়।’ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, ‘এখনই আমরা টাইমটা বলতে পারছি না। প্রসিডিওরটা কীভাবে হবে তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।