‘দুই বছর ধরে ফলের বাজার সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। আগে সকাল ও রাতের মেন্যুতে কিছু বিদেশি ফল থাকত। এখন খাওয়া হয় কালেভদ্রে।’ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর কাফরুলের বাসিন্দা মারুফ ইসলাম।
শুধু মারুফই নন, দেশের প্রায় সব নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের চিত্র একই রকম।
দাম বাড়তে থাকায় আপেল, আঙুর, খেজুর ও কমলার মতো বিদেশি ফল খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে ক্রেতারা। এতে বিদেশি ফল আমদানিও কমেছে। আবার মানুষ বিদেশি ফল খাওয়া কমিয়ে দিলেও উচ্চমূল্যের কারণে ক্রেতাদের খরচও বেড়েছে।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও বিভিন্ন ধরনের ফল কম খাওয়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে বলে স্বাস্থ্যবিষয়ক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, ফল আমদানি নিরুৎসাহ করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উচ্চ শুল্ক আরোপ করে। ফলভেদে শুল্কহার ১১৩.৮০ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারিত। এসব শুল্কের মধ্যে রয়েছে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), অগ্রিম আয়কর, আগাম কর, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও কাস্টমস শুল্ক।
বাজারে বর্তমানে আপেল বিক্রি হচ্ছে ৩৭৫ থেকে ৪৩৫ টাকার মধ্যে। কমলার বাজারদর ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা। আঙুর বিক্রি হচ্ছে ৩৯০ থেকে ৫৬০ টাকায়। মানভেদে বিভিন্ন ধরনের খেজুর ৪৫০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি হচ্ছে।
এনবিআরের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আমদানি তথ্য বলছে, শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের সঙ্গে কাস্টমসের বিভিন্ন ধরনের শুল্ক যোগ করে প্রতি কেজি আপেলের দাম পড়ে ১৫৬ টাকা।
কমলার দাম দাঁড়ায় ১৫১ টাকা। আঙুরের ১৮৮ টাকা। আর খেজুরের প্রতি কেজিতে দাম পড়ে ২৯০ টাকা।
আমদানি করা ফলের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা লাভ করেন কয়েক গুণ। যদিও তাঁরা বেশি দামের কারণ হিসেবে ডলারের লাগামহীন দর ও উচ্চ শুল্কহারকেই দায়ী করেন। বাস্তবতা হলো আপেল, কমলা, আঙুর কিংবা খেজুরের দাম বাড়ার পেছনে দায়ী অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। তাদের কারসাজিতে দেশবাসীর পক্ষে ফল খাওয়া অসম্ভব হয়ে গেছে। অন্যদিকে এক বছরের ব্যবধানে ফলের আমদানি কমেছে ২৮ হাজার মেট্রিক টন। বিদায়ি অর্থবছরেও আপেল, কমলা ও খেজুরের আমদানি কমেছে। আমদানি সামান্য বেড়েছে আঙুরের।
এনবিআরের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আপল আমদানি হয়েছে এক লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৫ মেট্রিক টন। আগের অর্থবছরে ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ৮১৮ মেট্রিক টন। কমলা আমদানি হয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার ৪৭০ মেট্রিক টন। আগের অর্থবছরে ছিল দুই লাখ ২০ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন। খেজুর আমদানি হয়েছে ৭৭ হাজার ৬১১ মেট্রিক টন। এর আগের অর্থবছরে এর আমদানি ছিল ৮৩ হাজার ৭০১ মেট্রিক টন। আঙুর আমদানি হয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ৮৬৫ মেট্রিক টন। এর আগের বছর এর আমদানি ছিল ৯৭ হাজার ৭৮৬ মেট্রিক টন।
ফল খেতে না পারার কারণে দেশবাসী পর্যাপ্ত পুষ্টি, ভিটামিন ও মিনারেল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা মনির বলেন, ‘আমার বাসায় বৃদ্ধ মা-বাবা ও ছোট শিশু আছে। ইচ্ছা থাকলেও দাম শুনে কেনার সাহস করি না।’
গবেষণাটি বলছে, ফল কম খাওয়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা সুস্থভাবে বাঁচার জন্য এবং মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের তাগিদ দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম বলেন, ফলের মধ্যে খাদ্যশক্তি থাকে, যা শরীরের ভেতর থেকে ক্ষতিকর চর্বি বের করে দেয়, তাই ফল সবার জন্য উপকারী। পুষ্টিমানের পাশাপাশি সব ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও খনিজ পদার্থ থাকে।
এদিকে ফলের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্রুত অভিযান চালানোর কথা জানিয়েছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক আব্দুল জলিল। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে প্রতিদিন আমাদের পাঁচ-ছয়টি টিম কাজ করে। ফলের বাজারে আমরা অভিযান চালাব।’
https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/10/07/1432610