স্বাধীনতা প্রত্যেক ব্যক্তি ও জাতি-রাষ্ট্রের জন্য আরাধ্য। স্বাধীনতাহীন জাতি নিজের আত্মপরিচয় নিয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। তাই স্বাধীনতা প্রত্যেকের জন্যই আত্মমর্যাদার ও অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বস্তুত, স্বাধীনতা হলো একটি এমন বিশেষণ, যা একটি জাতি, দেশ বা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ অবস্থান বোঝায়; যেখানে তাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা ও আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব থাকবে। স্বাধীনতার বিপরীত হচ্ছে পরাধীনতা। তবে স্বাধীনতা কোনো অর্থেই যা খুশি তাই করা বোঝায় না। এখানে স্বেচ্ছাচারিতার কোন সুযোগ নেই বরং তা তা আইন ও বিধি দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত। স্বাধীনতা সুদীর্ঘ বিপ্লব বা সহিংসতা যেভাবেই হোক, এর উদ্দেশ্য থাকে সার্বভৌমত্ব অর্জন করা; নিজস্ব স্বকীয়তা রক্ষা। যদিও কিছু বিপ্লবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকে জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন; তবে অধিকাংশই শুধুমাত্র ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়। আর স্বায়ত্তশাসনও এক ধরনের স্বাধীনতা, যেখানে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এবং নিজের কর্তৃত্বও বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তা লাভের নানাবিধ প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন নানাবিধ স্বকীয়তায় তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত, ঐতিহাসিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রধান তিনটি সময়কাল রয়েছে: ১৭৭০ এর দশকে শুরু হয়ে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৮২০ এর দশক পর্যন্ত চলে। তখন রাজকীয় দুর্গের পতন ঘটে এবং আমেরিকা স্বাধীন হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলস্বরূপ উসমানীয় সাম্রাজ্য ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং এর ফলে বলকান অঞ্চলে অনেক স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। এরপর ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলো থেকে ৭০টি নতুন রাষ্ট্র স্বাধীনতা পায়। একটি দেশ বা রাজ্যের স্বাধীনতা লাভ করার অনেক উদ্দেশ্য থাকে। স্বাধীনতা লাভের উপায়গুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ (যেমন : ভারত স্বাধীনতা আন্দোলন) থেকে শুরু করে সহিংসতা পর্যন্ত হতে পারে। যেমন, ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। যা অনেক রক্ত দিয়ে কিনতে হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্ট বিপ্লব তথা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতাও শান্তিপূর্ণ হয়নি বরং প্রায় দুই সহস্র প্রাণের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার এই যুগপৎ আন্দোলন বিজয়ী হয়েছে। অনেকে পঙ্গুত্ববরণ ও চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন।
বিশ্বের প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রই একবার স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, আমাদেরকে বারবার স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা বিশ^ ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ও নজীরবিহীন ঘটনা। ইতিহাস পর্যালোচনায় বিশ্ব ইতিহাসে আমাদের মতো অধিক মূল্য দিয়ে কোনো জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে বলে খুব একটা জানা যায় না। ১৭৫৭ সালের পলাশী ট্র্যাজেডির মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতার লাল সূর্যটা অস্তমিত হয়েছিল। মীর জাফরসহ অতি ঘনিষ্ঠজনদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব শহীদ সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা যখন আবার স্বাধীনতা ফিরে পেলাম তখন বেশ মূল্য দিতে হয়েছে আমাদেরকে। আমরা যদি সমসাময়িক স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিভিন্ন গৃহযুদ্ধের দিকে তাকাই তাহলে একথা অবশ্যই মানতে হবে যে, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের যে ত্যাগ ও কুরবানির প্রয়োজন হয়েছে, অন্যদের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। আমাদের স্বাধীনতা যেমন ছিল রক্তপিচ্ছিল, ঠিক তেমনিভাবে গৌরবেরও এবং আপন মহিমায় মহিমান্বিত।
মূলত, ভিয়েতনামে মুক্তি সংগ্রামে ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৭৫ সালে ৩০ এপ্রিল সায়গনের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শেষ হয়। এতে উভয় পক্ষের ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আলজেরিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ ১৮৩০ থেকে শুরু হয়ে ১৯৬২ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে। ১৯৬২ সালের ২ জুলাই আলজেরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। আলজেরিয়ার যুদ্ধের শেষের ৭/৮ বছরে ১০ লাখ আলজেরীয় প্রাণ হারান। কম্বোডিয়ায় গৃহযুদ্ধে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ২১ লাখ। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদার বাহিনীর পরাজয় পর্যন্ত ১৪ বছরের যুদ্ধে ৫০ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। ফলে তালেবানরা এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়।
ইরাক-ইরান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর হতে ১৯৮৮ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত। কিন্তু প্রাণহানির সংখ্যা ১০ লাখ অতিক্রম করেনি। এঙ্গোলায় ১৬ বছরের গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে ৩ লাখ এঙ্গোলাবাসী। ১৯৮১ সাল থেকে শ্রীলংকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে তা চলে দু’যুগেরও অধিককাল ধরে। প্রাণহানির সংখ্যা ১ লাখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বসনিয়া-হারজেগোভেনিয়ার ভয়াবহ যুদ্ধেও প্রাণহানির সংখ্যা দেড়লাখ অতিক্রম করেনি। কিন্তু আমাদের দেশে মাত্র ৯ মাসেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ত্রিশ লাখ। সম্ভ্রম হারিয়েছেন দু’লাখ মা বোন। যদিও উল্লিখিত সংখ্যা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের সমসাময়িক কালের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এতো চড়ামূল্য আর কোনো জাতিকে দিতে হয়নি।
অনিবার্য কারণেই ভারত বিভাজিত হয়েছে। ঠিক সঙ্গত কারণেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এক ও অখণ্ড থাকতে পারেনি। সাম্য, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, সামাজিক মূল্যাবোধ, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি ও সাংস্কৃতিক গোলামী থেকে মুক্তি লাভের জন্যই এদেশের আপামর জনসাধারণ ৯ মাসের মরণপণ মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল। কিন্তু যে প্রত্যাশা নিয়ে আমরা পিন্ডির গোলামীর শৃঙ্খল থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম সে প্রত্যাশা আমাদের কাছে অধরাই থেকে গেছে।
অনেক ত্যাগ-কুরবানি ও রক্তের বিনিময়ে গণমানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বাস্তবরূপ লাভ করেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এই জনপদের মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা দীর্ঘদিনের লালিত বিষয়। স্বাধীনতার লক্ষ্যে তারা যুদ্ধ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকি নবাব সিরাজউদ্দৌলা, শহীদ তিতুমীর, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানসহ আরও অনেক মহান নেতাকে। আমরা জানি যে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও কঠিন হলো স্বাধীনতা রক্ষা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা। এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত না হলে রাষ্ট্রও পরিণত হতে পারে ব্যর্থ রাষ্ট্রে।
একটি গণতান্ত্রিক, সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রিয় জন্মভূমিকে স্বাধীন করেছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর অতিমাত্রায় ক্ষমতালিপ্সা, অপরাজনীতি ও অহমিকার কারণে আমাদের স্বাধীনতার ৫ দশক অতিক্রান্ত হলেও সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বরং অর্জন যৎসমান্যই বলতে হবে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যখন পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করা উচিত ছিল তখন ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত বা চিরস্থায়ী করার জন্য যা যা করা দরকার তাই করেছে। বিশেষ মহলকে খুশি করার জন্য সংবিধানকে ভিনদেশী সংবিধানের ডুপ্লিকেট কপি বানালে তাও তাদের ক্ষমতাকে নিরাপদ করতে পারেনি। তাই তারা নিজেরাই সংবিধানে ৪ বার সংশোধনী এনেছিলো। যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলে দেশের মানুষকে মরণপণ যুদ্ধে ঠেলে দেয়া হয়েছিল, দেশ স্বাধীনের পর সে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অক্ষুন্ন রাখেনি স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দাবিদার রাজনৈতিক দল। তারা সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করেছিল। (Announcement Of declaration) Act-1975 মাত্র ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত পত্রিকা রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তদানীন্তন সরকার এই এক্ট পাসের আগেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করে আসছিলো। ১৯৭৩ সালের ২৯ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে দৈনিক গণকণ্ঠ সম্পাদক আল মাহমুদ অভিযোগ করেছিলেন, ‘গণকন্ঠ অত্যন্ত বেআইনিভাবে বন্ধ করে দেয়ার ফলে তথাকার পৌনে তিনশ’ সাংবাদিক ও কর্মচারী বেকার হইয়া পড়িয়াছেন। সাংবাদিক ও কর্মচারীদের মুহূর্ত মাত্র সময় না দিয়া অফিস হইতে কাজ অসমাপ্ত রাখা অবস্থায় বাহির করিয়া দেয়া হইয়াছে’। (ইত্তেফাক-৩০ মার্চ, ১৯৭৩)
জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্যর্থতার কারণেই আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক মানসিকতার কারণেই শিশু রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ধারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর ১৯৯৬ সালে দেশের নির্বাচন পদ্ধতির বিষয়ে একটি সমঝোতায় আসলেও ক্ষমতাসীনদের অবৈধ ক্ষমতালিপ্সার কারণই সে অর্জন নস্যাৎ হয়ে গেছে। ফলে আমরা রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সহনশীলতার অভাবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্রে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ব্যর্থতার কারণে আমরা কাক্সিক্ষত উন্নয়ন, জীবনমান, সুশাসন ও নিরাপত্তা লাভে সমর্থ হইনি। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট আজ দেশ-বিদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। ২০০৮ সালে একটি বিতর্কিত মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে গণতন্ত্র, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের রক্ষাকবজ কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেশে নতুন করে রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে। বিরোধী দলগুলোর কেয়ারটেকার সরকারের দাবির প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব তারানকো। কিন্তু এতে তিনি সফল হননি। ফলে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা জাতির ঘাড়ে আবারও জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। সেই কথিত নির্বাচনে বিনাভোটেই ১৫৪ সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে জাতীয় সংসদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। বাদবাকী আসনে একতরফা নির্বাচনও অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বরং ভোট ডাকাতি ও কেন্দ্র দখলের মহড়া চলেছে। কোন কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা না গেলেও ভোটের বাক্সে ভোটের কোন অভাব হয়নি। যা ছিল নির্বাচন ও গণতন্ত্রের নামে নির্মম প্রহসন এবং জনগণের সাথে তামাশার শামিল।
আর ২০১৮ সালের নির্বাচন তো রীতিমত নৈশকালীন ইলেকশন হিসাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতি পেয়েছিল। আওয়ামী-বাকশালী প্রশাসনের লোকেরা ভোটের আগের দিন রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে ক্ষমতাসীনদের ভূমিধস বিজয় নিশ্চিত করেছিল। আর এক্ষেত্রে নেপথ্যে ভূমিকা পালন করেছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান এম এ আজিজ। আর সে সময়ের নির্বাচন কমিশনের নামে হুদা কমিশন পালন করেছিলো সহায়ক ভূমিকা। পরিণত হয়েছিল বেহুদা কমিশনে।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের কাহিনীও কারো অজানা নয়। কথিত এ নির্বাচনে নির্বাচনের নামে চলেছিল চর দখলের মহড়া। এই নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ^ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করলেও বাকশালী ও ফ্যাসিবাদীরা সেসব কথায় কর্ণপাত করেনি বরং বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের সহায়তায় কথিত নির্বাচনের নামে প্রহসন ও জনগণকে ধোঁকা দিয়েছে টানা চতুর্থবারের মত ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী বাকশালী ও ফ্যাসিবাদীরা। আর এভাবের দেশের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জাতীয় স্বকীয়তার কবর রচনা করা হয়েছিল।
দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দাঁড়িয়েছিল খাদের কিনারে। পরমত সহনশীলতা গণতন্ত্রের মূল উপাদান। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের কতিপয় অধিকার সংরক্ষণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক ৩ ধরনের অধিকার ভোগ করবে : ১. সামাজিক অধিকার, ২. রাজনৈতিক অধিকার এবং ৩. অর্থনৈতিক অধিকার। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে নিম্নে নাগরিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো : সামাজিক অধিকার : জীবন ধারনের অধিকার. ২. ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, ৩. মতপ্রকাশের অধিকার, ৪ সভা-সমিতি করার অধিকার, ৫. সম্পত্তি ভোগের অধিকার, ৬. ধর্মীয় অধিকার, ৭. আইনের অধিকার, ৮. চুক্তির অধিকার, ৯. ভাষার অধিকার, ১০. পরিবার গঠনের অধিকার ও ১১. শিক্ষা লাভের অধিকার।
রাজনৈতিক অধিকার : ভোটাধিকার, ২. প্রার্থী হওয়ার অধিকার, ৩. অভিযোগ পেশ করার অধিকার, ৪. সমালোচনার অধিকার, ৫. চাকরি লাভের অধিকার ও ৬. বসবাসের অধিকার।
অর্থনৈতিক অধিকার : কাজের অধিকার, ২ উপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, ৩. অবকাশ যাপনের অধিকার, ৪. সংঘ গঠনের অধিকার ও ৫. রাষ্ট্র প্রদত্ত প্রতিপালনের অধিকার ইত্যাদি।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকের যেসব অধিকারের স্বীকৃত রাষ্ট্র তার নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেনি বরং নাগরিকরা তাদের অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ এসব অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রেরই সাংবিধানিক দায়িত্ব। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র জনগণের শাসন, শাসক গোষ্ঠীর জবাবদিহিতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যমকে সরকার মোটেই গুরুত্ব না দিয়ে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যই গণতান্ত্রিক সকল রীতিনীতি উপেক্ষা করছে যা আমাদের জন্য রীতিমতো অশনি সংকেত হয়ে দেখা দিয়েছিল। মূলত শাসনকার্যে জনগণের সম্পৃক্ততা উপেক্ষা করে দেশকে এগিয়ে নেয়া মোটেই সম্ভব ছিল না। আওয়ামী শাসনামলে তা হয়নি বরং অবৈধ ক্ষমতালিপ্সা দেশকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছিল।
মূলত পুঁজিবাদ, সম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া মহাজনী মূলধনের চরম জাতীয়তাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ও সন্ত্রাসমূলক প্রকাশই হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ চরম জাতীয়তাবাদী, অযৌক্তিক ধর্ম ও বর্ণবিদ্বেষ এবং উদ্দেশ্য সাধনে চরম বর্বরতার আদর্শ প্রচার করে। ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদের চরম সঙ্কটের পরিচয়বাহক। সাম্রাজ্যবাদী যুগ হচ্ছে পুঁজিবাদের চরম যুগ। জাতীয় ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের বিকাশ যখন নিঃশেষিত, তখন পুঁজিবাদ নিজের শোষণমূলক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য সাম্রাজবাদী চরিত্র গ্রহণ করে। ফ্যাসিবাদের মূলনীতিগুলো নিম্নরূপ :
ক. ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল নয়। মূলত ফ্যাসিবাদ ছোট, মধ্যম, বড় এবং সর্বোচ্চ নেতা যা আদেশ করবেন, তাই রাষ্ট্রের আদেশ বলে নির্বিবাদে মেনে নিতে হবে।
খ. ফ্যাসিবাদ সমাজতন্ত্রেও অবিশ্বাস করে।
গ. ফ্যাসিবাদে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বতন্ত্র স্বীকৃত হয় না। ফ্যাসিবাদের মূলমন্ত্র হলো সবকিছুই রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত, কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয় বরং কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বাইরে নয়।
ঘ. ফ্যাসিবাদ শান্তি কামনা করে না। ফ্যাসিবাদ নিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়। মুসোলিনির মতে, মহিলাদের নিকট যেমন মাতৃত্ব, পুরুষদের নিকট তেমন যুদ্ধ-বিগ্রহ।
ঙ. ফ্যাসিবাদে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং দলীয় নেতা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে আসীন হন। একদল ও একনেতা সরকারের এবং সমাজের সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন।
চ. ফ্যাসিবাদে এলিট শ্রেণির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে বিশ্বাস করা হয় যে, পৃথিবীতে কিছু ব্যক্তি শাসন করতে এবং শাসিত হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করে।
আর এসকল বৈশিষ্ট্য আওয়ামী লীগের মধ্যেই পাওয়া যায়। তাই আওয়ামী লীগ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ফ্যাসিবাদী এবং মাফিয়াতান্ত্রিক শক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। আর ছাত্র-জনতার যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে তারা এখন রীতিমত ক্ষমতাচ্যুত ও দেশান্তরী। কিন্তু আমরা এখনো ফ্যাসিবাদের আছর মুক্ত হতে পারিনি।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ এদেশে বিভেদের রাজনীতি শুরু করে। আর এই বিভেদের রাজনীতির কারণেই আমরা স্বাধীনতার সুফলগুলো পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারিনি বরং অনেকটাই পিছিয়ে গেছি। বিশ্বের প্রত্যেক জাতিরাষ্ট্র যখন উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরহণ করতে সক্ষম হচ্ছে, তখন আমরা নিজেরাই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছি। আমরা যে প্রত্যাশা নিয়ে পিন্ডির গোলামী থেকে মুক্তি লাভের জন্য মরণপণ যুদ্ধ ও বিজয় অর্জন করেছিলাম আওয়ামী প্রতিহিংসা ও অপরাজনীতির কারণে এর সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি। দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুস্থধারার রাজনীতি চর্চার সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় কোন গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজ চলতে পারে না। যে প্রত্যাশা নিয়ে আমরা মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার লাল সূর্যটা ছিনিয়ে এনেছিলাম, কিন্তু প্রাপ্তিটা অনেকটাই অধরাই রয়ে গেছে।
এমতাবস্থায় দেশ ও জাতির ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। যে প্রজন্মকে আমরা মোবাইল প্রজন্ম বলে উপহাস করতাম সে প্রজন্মই আমাদের জন্য এনে দিয়েছে এক ঐতিহাসিক এবং সম্মানজনক বিজয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলন এবং বিজয়ের মাধ্যমে দেশে ফ্যাসিবাদী শক্তির পতন ঘটেছে। এই বিজয়কে আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসাবে উল্লেখ করলেও শঙ্কা এখনো পুরোপুরি কেটে যায়নি। কারণ, ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতিভূরা এখনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে তৎপর রয়েছে। তাই ছাত্র-জনতার এই বিজয়কে টেকসই ও ফলপ্রসূ করার জন্য আমাদেরকে অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হতে হবে। রাষ্ট্রের সকল সেক্টর থেকে ফ্যাসিবাদের শেকড় উপরে ফেলা দরকার। অন্যথায় স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো আমাদের কাছে অধরাই থেকে যাবে।