দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর যুদ্ধাপরাধের মতো গুরুতর অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ‘দালাল আইনে’ হাজার হাজার মামলাও করা হয়। পরবর্তীতে তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান যারা কয়েকটি গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িত তাদের ব্যতীত বাকিদের সাধারণ ক্ষমা করে দেন। এ নিয়ে তখন কেউ কোনো আপত্তি উত্থাপন করেননি। এমনকি শেখ মুজিবের বিশেষ অনুমতি নিয়ে জামায়াত নেতা মাওলানা আবদুর রহীম দেশে ফিরে আসেন। এরূপ ক্ষমার পরও কয়েক হাজার মামলা বহাল ছিল। জেনারেল জিয়ার আমলে ‘দালাল আইন’ বাতিল হওয়ায় মামলাগুলো আর চলেনি। জামায়াত নেতাদের প্রথম সারির কেউ ওইসব মামলার আসামি ছিলেন না। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন প্রণয়ন করা হয়, যার আওতায় ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এমন ১৯৫ জনের বিচার করা। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা-ভুট্টোর মধ্যে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তির আওতায় পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ফেরত নেয়া হলে বাংলাদেশে প্রণীত আইনের প্রাসঙ্গিকতা আর থাকেনি।
দীর্ঘ ৩৮ বছর পরে ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন সংশোধন করে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন এমন ব্যক্তিদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মাধ্যমে মূলত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচারে সুবিধামতো বিভিন্ন নতুন ধারা সংযোজন ও তড়িঘড়ি করে তা পার্লামেন্টে পাস করা হয়।
মূলত ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে আওয়ামী লীগের সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ে জামায়াতের ওপর। জামায়াতের ৮-১০ শতাংশ ভোট বিএনপির বাক্সে পড়েছে বলে চারদলীয় জোট জিতেছে। সুতরাং আওয়ামী লীগের পরাজয়ে সব দোষ যেন ছিল জামায়াতের। সেদিন থেকে শুরু হয় ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচারের দাবি। জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা আবার জোট সরকারের মন্ত্রী হয়ে যে ক্লিন ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন তাতে আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়ার শামিল হয়। জামায়াত নেতারা স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে গাড়িতে ঘুরে বেড়াবেন- এটি আওয়ামী লীগ নেতারা কিভাবে সহ্য করবেন? এই রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব ও ভোটের অঙ্ক আওয়ামী লীগকে চূড়ান্তভাবে জামায়াতবিদ্বেষী করে তুলে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রকাশিত নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে আওয়ামী লীগ কড়া ভাষায় জামায়াত সম্পর্কে বলেছিল, দলটি ‘স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি’। জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে দলটির এ অবস্থান নতুন কিছু নয়। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো থাকে পরস্পরের প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বী, তবে কোনোক্রমে শত্রুতার পর্যায়ে যায় না। সহনশীলতা গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক লক্ষ করা যায়; তা কোনোভাবে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দিক থেকে কঠোর মনোভাব লক্ষ করা যায়। এর আগেও আওয়ামী লীগ ঘোষণা দেয়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের দাওয়াত দেয়া হলে তারা সেখানে যাবে না। দেখা গেল, বিজয় দিবসে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জামায়াতের নেতাদের দাওয়াত দেয়া হলে আওয়ামী লীগ নেতারা সেখানে যাননি।
আওয়ামী লীগ জামায়াতকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে কোণঠাসা করে রাখতে সচেষ্ট থাকে। এ দুটো দলের মধ্যকার বৈরী সম্পর্কের স্বরূপ বুঝতে হলে ইতিহাসের একটু পেছনে যেতে হবে। ১৯৭১ সালে জামায়াত রাজনৈতিক কারণে স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়। সুতরাং স্বাভাবিক কারণে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল।
অধ্যাপক গোলাম আযম যখন রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে আর জামায়াতের নেতৃত্বে নেই; তখনো তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। তার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের যে রায় ছিল তাকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছিল না। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অহরহ ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলা হচ্ছিল। সরকার নিয়ন্ত্রিত বিটিভিতে নানা কার্টুন দেখিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল চালানো হতে থাকে। তথাকথিত মানবতাবিরোধী কর্মের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হলে যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে বলেছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
এটি সুস্পষ্ট যে, জামায়াত নেতারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন। এ জন্য বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু তারা কোনো খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ বা লুটপাটের সাথে জড়িত ছিলেন বলে দীর্ঘ ৫০ বছরেও দেশের কোনো থানায় কোনো মামলা হয়নি। ওই সময়ে তারা কেউ সশস্ত্র কোনো বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন না। তারা কেউ সরাসরি যুদ্ধেও লিপ্ত ছিলেন না। বাস্তবতা এটাই যে, তারা পাকিস্তানের পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছিলেন। তখন চীনপন্থী কমিউনিস্টরা মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। কই তাদের বিষয়ে কেউ তো কিছু বলেন না? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজামী ও মুজাহিদ কেউ দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করেছেন এমন নজির নেই।
নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়। এ জন্য প্রথম উদ্যোগ হিসেবে তারা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনালস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট ১৯৭৩ সংশোধন করে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, আইনটি মূলত প্রণয়ন করা হয়েছিল পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের জন্য। কিন্তু ২০১০ সালে সরকার সে উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে দালাল আইনে যাদের বিচার করা হয়েছিল তাদের মূল যুদ্ধাপরাধী বিচারে প্রণীত আইনের আওতায় বিচারের কার্যক্রম গ্রহণ করে। দ্রুততার সাথে প্রধানত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। বিতর্কিত বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে জামায়াতের ছয়জন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। জামায়াতসহ অনেকে নানা প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া দেখালেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের হাজার হাজার নেতাকর্মী জেল-জুলুম ও নির্যাতনের মুখে পড়েন। তাদের সব অফিস তালাবদ্ধ করে দেয়া হয়। একপর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী নিবন্ধন বাতিল করা হয়। তাদের কোনো সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি।
ভারত জামায়াতের শক্তি, জনসমর্থন ও উত্থান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সেক্যুলার, নাস্তিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিককর্মীরা মিলে ঢাকার শাহবাগে কথিত ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ তৈরি করে সেখানে মানবতাবিরোধী/যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে গণজমায়েত ও বিক্ষোভ পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরে নতুন আইন করে ভূতাপেক্ষ কার্যকরতা দেয়ার বিধান নেই। নতুন আইন করে জামায়াত নেতাদের ৪০ বছর আগে সংঘটিত ঘটনার বিচার করা হয়। ‘গণজাগরণ মঞ্চের’ দাবির মুখে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ পরিবর্তন করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এরূপ তামাশার বিচার ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।
হাসিনা সরকারের কথিত মানবতাবিরোধী/যুদ্ধাপরাধের যেখানে আইনগত বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা ও ত্রুটি ছিল; সেখানে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে- হাসিনা সরকার আসলে কী উদ্দেশ্যে এ রকম একটি বিতর্কিত কাজে অগ্রসর হয়েছিল? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকার কিছু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে নি¤œলিখিত বিষয়গুলো প্রণিধানযোগ্য :
প্রথমত. আওয়ামী লীগ সরকার একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল। বিভিন্ন লক্ষণ থেকে এটি স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়েছিল যে, প্রতিবেশী একটি দেশ ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় তাদের নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করা হয়। আবার এটাও বাস্তব যে, বিদেশী রাষ্ট্রগুলো স্বার্থ ছাড়া কাউকে কোনো সুবিধা দেয় না। বিশেষ করে বাংলাদেশে ভারতের অনেক স্বার্থ রয়েছে; যেমন : ১. চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা; ২. ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সাথে দ্রুত ও কম খরচে যাতায়াতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধা; ৩. পদ্মা ও তিস্তা নদীর পানি ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টনের ইস্যু ঝুলিয়ে রাখা; ৪. ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের বিরোধিতা ছাড়া নির্বিঘেœ নির্মাণ; ৫. বাংলাদেশে ভারতীয় বাজার সম্প্রসারণ ও লাখ লাখ ভারতীয়র কর্মসংস্থান ইত্যাদি। ভারত আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে দ্রুত এসব স্বার্থ আদায় করতে ছিল বেশ তৎপর। শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে এসব বিষয়সহ দিল্লির অনুকূলে প্রদানে অর্ধশত প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন। এ মর্মে চুক্তিও স্বাক্ষর করেন। বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বার্থ সমভাবে সংরক্ষিত হয়নি। যদিও চুক্তির বিস্তারিত দেশবাসীকে জানানো হয়নি। দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী এ চুক্তির বিপক্ষে; এ নিয়ে বহু প্রতিবাদ ও সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে দেশের জাতীয়তাবাদী শক্তি বিএনপি ও বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির বিরুদ্ধে বেশি সোচ্চার ছিল। ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হলে এসব শক্তির প্রতিবাদ আরো জোরালো হতে পারে- এ আশঙ্কায় কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যু সামনে আনা হয়, যাতে করে সরকারবিরোধীদের মানোবল দুর্বল করে দেয়া যায়। সরকারবিরোধী শক্তির উপরে চাপ বজায় রেখে ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির বাস্তবায়ন কাজ শুরু করতে পারে।
দ্বিতীয়ত. সরকার বিগত নির্বাচনের সময়ে জনগণকে গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; যেমন- দ্রব্যমূল্য কমানো, ১০ টাকা কেজিতে চাল, ঘরে ঘরে চাকরি, বিনামূল্যে সার, বিদ্যুৎ ও পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ইত্যাদি। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এ ধরনের প্রতিশ্রুতির কোনোটি সরকার পূরণ করতে পারেনি। ফলে জনদুর্ভোগ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছিল। দ্রব্যমূল্য পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে, চালের দাম সর্বনিম্ন ৬০-৭০ টাকা, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহে বিরাট সঙ্কট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিরোধী দলের উপর নির্যাতন, ছাত্রলীগ কর্মীদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, বেকারত্ব ইত্যাদি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। সরকার নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার ও জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যু সামনে আনে।
তৃতীয়ত. আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন পেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা তখন তাদের পছন্দ করত না। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পরে পুঁজিবাদের প্রতিভূ যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য চালাচ্ছে। ভারত এক সময়ে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের প্রভাববলয়ে ছিল। ক্রমান্বয়ে পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সখ্য গড়ে তুলে। দেখাদেখি আওয়ামী লীগও সমাজতান্ত্রিক নীতি পরিত্যাগ করে পুঁজিবাদী ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের দিকে মুখ ফিরায়। তখন সহজে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়ার সবচেয়ে বড় কৌশল হলো তথাকথিত মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তথা ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করা। এ নীতির অনুসারীদের পুরো সমর্থন দিয়েছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং ইহুদি নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া। এ কৌশলের অংশ হিসেবে সরকার কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যু সামনে এনে দেশের বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতের ওপর ক্র্যাকডাউন করেছিল।
চতুর্থত. নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য বড় প্রতিদ্বন্দ্বী দল ছিল বিএনপি। এই বড় দুটো দলের জনসমর্থন প্রায় সমান সমান। বিএনপি যদি জামায়াতের সমর্থকদের ভোট লাভ করে সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পক্ষে জয়লাভ করা অনেকটা কঠিন হয়ে যায়। এ অবস্থায় বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা গেলে আওয়ামী লীগের জন্য বড় একটি বাধা অপসারিত হয়। এ কৌশলের অংশ হিসেবে সরকার কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যু সামনে এনে জামায়াতের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়; যাতে পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের জন্য জয়লাভ নির্বিঘœ হয়।
পঞ্চমত. আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সংবিধানে পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধের যে প্রতিফলন ঘটেছিল তা কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি। এ জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পেয়ে যায়। তবে জানতো যে, এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এটি মেনে নিতে চাইবেন না। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ হবে সব কর্মের ভিত্তি সংযোজন করেন। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট এরশাদ অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত করেন। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ আদালতের রায়ের মাধ্যমে পঞ্চম ও ত্রয়োদশসহ কতগুলো সংশোধনী বাতিল করে দিয়ে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে প্রত্যাবর্তন করে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি- সবাই এর বিরোধিতা করে। ইসলামী দলগুলো অবশ্য ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করে। সরকার বিএনপি ও জামায়াতের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যতিব্যস্ত রেখে সংবিধান সংশোধনীর কাজটি করে।
ষষ্ঠত. বাম রাজনীতির ভবিষ্যৎ এ দেশে অন্ধকার। বামপন্থীদের এক বিরাট অংশ বাম রাজনীতির মূল্যবোধ পরিত্যাগ করে আওয়ামী লীগের মতো পেটি বুর্জোয়া দলের উচ্ছিষ্ট ভোগের প্রতিযোগিতায় নামে। বাম রাজনীতিকরা তাদের আদর্শ ও নীতির দেউলিয়াত্বে একমাত্র ইসলামী আদর্শবাদী দলগুলোকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন। তারা ভারত ও আওয়ামী লীগের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে জামায়াতে ইসলামীকে নির্মূল করতে সরকারকে কুপরামর্শ ও সহযোগিতা দেয়।
উল্লিøখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এ কথা বলা যেতে পারে, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের অভিপ্রায় পূরণ ও রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ত্রুটিপূর্ণ বিচার করে তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে।
লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
(ayubmiah@gmail.com)