দেশের দুই শীর্ষ ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান ও নজরুল ইসলাম মজুমদারের অর্থ পাচারের তথ্য পেয়ে হতবাক হচ্ছেন গোয়েন্দারা। গত ১৫ বছরে তারা বিভিন্ন ভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। সালমান এফ রহমান সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসামরিক, শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সালমান। অন্যদিকে নাসা গ্রুপ ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। বর্তমানে এই দুই শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়ে হেফাজতে আছেন। তাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের অর্থ পাচারের তথ্য অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
সালমান এফ রহমান বিরুদ্ধে এখন রপ্তানির আড়ালে পর্যন্ত তিনি হাজার কোটি টাকা পাচার করার তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার যত কৌশল আছে, তার সবগুলোই প্রয়োগ করেছেন সালমান এফ রহমান। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার নতুন নিয়ম তৈরি করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বাধ্য করেছিলেন তিনি। দেশে ঋণ খেলাপের ‘পথিকৃৎ বলা হয় তাকে। তিনি কত টাকার মালিক তার প্রকৃত হিসাব কারো কাছে নেই। এখন পর্যন্ত সালমানের বিরুদ্ধে ১৭ মামলা হয়েছে। অন্যদিকে নাসা গ্রুপ ও বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নাসা গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৪টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা। শত শত কোটি টাকা দুবাই, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে পৃথক অনুসন্ধান করছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঋণের টাকা ফেরত না দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংককে বড় ঝুঁকিতে ফেলেছে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সালমান এফ রহমানের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার ওপরে। তাই সালমান এফ রহমানকে বাংলাদেশের ‘ঋণ খেলাপের জনক’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন অনেকেই। গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান শেয়ারবাজার ও ব্যাংক খাতে কেলেঙ্কারির মূলহোতাদের একজন হিসেবে গত ১৫ বছর ধরেই আলোচনায় ছিলেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ গ্রহণ ও সময়মতো পরিশোধ না করার পাশাপাশি কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে তুলে নিয়েছেন ৬ হাজার কোটি টাকা। বেক্সিমকোর শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে গত মঙ্গলবার ৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৪২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা জরিমানা করেছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের শেয়ারবাজার এবং ব্যাংক খাতকে বিপর্যস্ত অবস্থায় রেখে গেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ অবস্থার জন্য অন্যতম দায়ী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উপদেষ্টা। সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে সরকারি এই ব্যাংকটিকে ঝুঁকিতে ফেলেছেন। তার ঋণের পরিমাণ ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে নয় গুণ বেশি। এটা সালমানের ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার অনেক ঘটনার মাত্র একটি উদাহরণ।
এছাড়া অর্থ পাচার মামলায় সালমান এফ রহমান ছাড়াও তার ছেলে, ভাই, ভাতিজাসহ প্রতিষ্ঠানের ২৪ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মামলায় রপ্তানির আড়ালে ৮৩ মিলিয়ন বা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণপূর্বক আত্মসাতসহ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে দুদক উপপরিচালক ও অনুসন্ধান টিম প্রধান মো. মনজুর আলম একটি তলবি চিঠি দিয়েছে সালমান এফ রহমানকে। তলবি চিঠিতে সোনালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ডাচ বাংলা ব্যাংক পিএলসির বিভিন্ন শাখা বরাবর পাঠানো হয়েছে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানের স্বার্থে ব্যাংকগুলোর লোকাল শাখাসহ অন্যান্য শাখায় সালমান এফ রহমান ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রদত্ত ব্যক্তিগত ঋণ এবং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদত্ত বা বরাদ্দকৃত মোট ঋণের পরিমাণ, এ ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানত, ঋণ আবেদন-প্রস্তাব-অনুমোদন ও ঋণ বিতরণ, সুকুক বন্ডের বিপরীতে প্রদত্ত ঋণসহ বরাদ্দকৃত এবং বিতরণকৃত সব ঋণ সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র তলব করা হয়েছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওইসব নথিপত্র পাঠানোর অনুরোধ করেছে দুদক। ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে গত ২২ আগস্ট অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
এদিকে নজরুল ইসলাম মজুমদার নাসা গ্রুপ ও বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তবে এসব ছাপিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসাবে তার পরিচিতি সর্বত্র। তিনি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান পদে আছেন টানা প্রায় ১৫ বছর। এই পদে যাওয়ার পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদে তিনি দেশের ব্যাংক খাতের অন্যতম মাফিয়া বনে যান। আর্থিক খাতের নানা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজির টাকায় দেশ-বিদেশে গড়ে তোলেন অঢেল সম্পদ। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের একাধিক দেশে রয়েছে তার বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ। তবে শেষ পর্যন্ত ‘চোরের দশ দিন গৃহস্থের একদিন’ প্রবাদের মতো তারও শেষ রক্ষা হয়নি। তিনিও ধরা পড়লেন। মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) মধ্যরাতে নজরুল ইসলাম মজুমদারকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে মজুমদার ব্যাপক ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। অংশীদারি ব্যবসা হলেও ক্ষমতার দাপটে নাসা গ্রুপে তিনি একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেন। এক পর্যায়ে কোম্পানির ২০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার ও স্পন্সর পরিচালক আলতাফ হোসেনকে বেআইনিভাবে বের করে দেওয়া হয়।
সিআইডির সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নাসা গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৪টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়ে শত শত কোটি টাকা দুবাই, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে পৃথক অনুসন্ধান করছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। লন্ডন এবং হংকং ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। সেখানে রিয়েল এস্টেট খাতে একাধিক কোম্পানি খুলে তিনি ব্যবসা করছেন। এছাড়া ২০১৫ সালের দিকে তিনি সৌদি আরবের কৃষি খাতে বিনিয়োগ করেছেন। সৌদির একাধিক খেজুর বাগানে তার বিনিয়োগ রয়েছে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে নজরুল ইসলাম মজুমদারকে সরিয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে তিনি ২০০৭ সাল থেকে ব্যাংকটিতে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া প্রায় দেড় দশক ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।