বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ৫ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিপুল অঙ্কের এ অর্থ ঋণের নামে সাদ মুসা গ্রুপসহ ৫টি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ ঋণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই করা বা গ্রুপগুলোর অতীত ঋণের সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেন ব্যুরো) রিপোর্ট দেখা হয়নি। এমনকি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় ব্যাংক গ্যারান্টিও নেওয়া হয়নি। কোন খাতে এ ঋণ বিনিয়োগ করা হবে-তারও কোনো ঘোষণাসংক্রান্ত তথ্য নেই ঋণের নথিতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ যেন কাগজে-কলমে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা। সাদ মুসাসহ যে প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ নিয়ে গেছে তারা এখন লাপাত্তা।
এমন বাস্তবতায় এত বড় ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ লুটের ঘটনা ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদের নজরে এলে সাদ মুসা গ্রুপসহ ৫ প্রতিষ্ঠানকে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ ঘোষণা করে। মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা জারির পর প্রথম ব্যাংক হিসাবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করল ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংক খাতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ঘোষণার এটিই প্রথম নজির বলে জানা গেছে। ২ অক্টোবর (বুধবার) ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করা হয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
ইচ্ছকৃত ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চট্টগ্রামের সাদ মুসা গ্রুপ ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস ছাড়াও রয়েছে এফএমসি ডকইয়ার্ড নামক একটি প্রতিষ্ঠান ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডস মালটি ট্রেড করপোরেশন। এই তালিকায় আরও আছে ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট নামের আরও একটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ন্যাশনাল ব্যাংক পরিচালনায় যুক্ত পরিচালনা পর্ষদ এই গ্রুপগুলোকে ঋণের নামে জনগণের আমানত বের করে দিয়েছে। তবে তারাও এখন নেই। ফলে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদকে। কীভাবে এই ঋণের অর্থ আদায় হবে-এ বিষয়ে একজন দায়িত্বশীর কর্মকর্তা বলেন, এখন আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি নির্ধারণ ও এসব খেলাপির বিভিন্ন সুবিধা বাতিলের বিষয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করতে এপ্রিলের প্রথমভাগেই আলাদা ইউনিট গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরবর্তী দুই ধাপ নিচের কোনো কর্মকর্তাকে এ ইউনিটের প্রধান করতে বলা হয়। ইউনিটটির কাজ হচ্ছে-খেলাপি ঋণের মধ্যে থাকা বেনামি, জাল-জালিয়াতি করে নেওয়া ঋণ, প্রতারণা ও ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা ঋণকেও ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা।
জারি করা প্রজ্ঞাপনের বিধান অনুযায়ী, সাদ মুসা গ্রুপসহ ৫ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণে এবং ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞায় পড়বেন। একই সঙ্গে বাড়ি-গাড়ি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধনে কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থার আইন-বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হবে। এছাড়া ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধের পর ৫ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। ব্যাংক সূত্রমতে জানা যায়, ন্যাশনাল ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা থেকে নেওয়া সাদ মুসা গ্রুপের ঋণ দীর্ঘদিন থেকেই খেলাপি। এই প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। গ্রুপটির অপর সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলসও ন্যাশনাল ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ করছে না। ন্যাশনাল ব্যাংক দিলকুশা শাখা থেকে নেওয়া এই ঋণের বর্তমান স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯৮৭ কোটি টাকা। একই শাখা থেকে নেওয়া এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের ঋণও আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এই ইচ্ছাকৃত খেলাপি থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের পাওনা ১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এমনকি এফএমসির অপর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডস মালটি ট্রেড করপোরেশনও দিলকুশা শাখা থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করছেন না। এই প্রতিষ্ঠানটির কাছে আটকা আছে ৩৭৬ কোটি টাকা। এছাড়া রাজধানীর মহাখালী শাখা থেকে ৭৪১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে পড়েছে ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেট লিমিটেড।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, চলতি বছরের মার্চে জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার-৬ এর নির্দেশনা পালন করেছে ন্যাশনাল ব্যাংক। সোমবার পরিচালনা পর্ষদ ৫ প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে। পরে বুধবার ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে ঘোষণা করা হয় তাদের। এদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তৌহিদুল আলম খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়া অভিযুক্ত সাদ মুসা গ্রুপসহ অপর প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের বক্তব্য জানতে ফোন করা হলেও কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায়, এরা সবাই গা ঢাকা দিয়েছে।