এক সময় দেশের মানুষের কাছে খুলনার পরিচিতি ছিল ‘শিল্পনগরী’ হিসেবে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা শ্রমিক-কর্মচারীর কোলাহলে মুখর থাকত শিল্প এলাকাগুলো। সেই সুনাম এখন নেই। খুলনার পরিচিতি এখন ‘বন্ধ শিল্পের নগরী’। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, খুলনা এখন ‘মৃত শিল্পনগরী’।
খুলনায় ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সাতটি পাটকল, ব্যক্তিমালিকানাধীন চারটি পাটকল, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল, হার্ডবোর্ড মিল, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি, টেক্সটাইল মিল, কোরাইশি স্টিল মিল এবং খুলনা অক্সিজেন লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া বন্ধ হয়েছে বেশির ভাগ লবণ মিল এবং চিংড়ি রপ্তানিকারক কারখানাসহ অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বন্ধের তুলনায় নতুন করে গড়ে ওঠা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নগণ্য। এমন পরিস্থিতিতে খুলনার দুটি শিল্প এলাকার জনসংখ্যা কমেছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার।
মিলগুলো বন্ধ থাকায় অসংখ্য শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। কেউ রিকশা-ভ্যান চালিয়ে, কেউ দিনমজুরি করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছেন। আবার অনেকে কোনো কাজ পাননি। সংসারের অন্য কারও আয় দিয়ে চলছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের চিত্র
লোকসানের কারণ দেখিয়ে ২০২০ সালের ২ জুলাই খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত সাতটি পাটকল বন্ধ করে দেয় বিজেএমসি। এর ফলে ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, খালিশপুর ও দৌলতপুর, আলীম ও ইস্টার্ন এবং স্টার জুট মিলের প্রায় ২৬ হাজার স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিক চাকরি হারান। লিজের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করে তিন মাসের মধ্যে মিলগুলো আবার চালু করার ঘোষণা দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। ইজারা নিয়ে ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর দৌলতপুর জুট মিল দায়সারাভাবে চালু করেছে ফরচুন গ্রুপ। ২৫০টি তাঁতের মধ্যে চালু হয়েছে মাত্র ২০টি। আগে শ্রমিক ছিল ২ হাজার ২৮২ জন। এখন আছেন মাত্র ২০০ জন। এখানকার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে তারা চার সপ্তাহের মজুরি পেতেন ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা। এখন মাসে গড়ে ১০ হাজার টাকা মজুরি পান। এদিকে চার মাস আগে ইস্টার্ন জুট মিল ভারতের রিগ্যাল জুট নামের একটি প্রতিষ্ঠান ইজারা নিয়ে কোনোমতে চালু করেছে।
পাট সুতা বস্ত্রকল শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. খলিলুর রহমান বলেন, তাদের দাবি, মিলগুলো আধুনিকায়ন করে আবার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় চালু করা হোক। কিন্তু বিজেএমসি তা করছে না। বিজেএমসির খুলনার আঞ্চলিক সমন্বয় কর্মকর্তা মো. গোলাম রব্বানী জানান, আলীম জুট মিলের মালিকানা নিয়ে মামলা রয়েছে। ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, খালিশপুর ও স্টার মিল ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তবে কবে নাগাদ চালু হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না।
ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল
মীরেরডাঙ্গা এলাকার ব্যক্তিমালিকানাধীন সোনালি জুট মিল বন্ধ হয়ে যায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। চাকরি হারান মিলের স্থায়ী ও বদলি ৪ হাজার ৭০০ শ্রমিক। তাদের পাওনা রয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। একই এলাকার অ্যাজাক্স জুট মিল বন্ধ রয়েছে ২০১৩ সাল থেকে। মিলের ২ হাজার শ্রমিকের পাওনা রয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। আটরা শিল্পাঞ্চলের আফিল জুট মিল ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে বন্ধ। মিলের ৯৪৮ জন স্থায়ী ও ৪৯৬ জন বদলি শ্রমিকের পাওনার পরিমাণ ৩৫ কোটি টাকা। শিরোমনি বিসিক শিল্প এলাকার মহসিন জুট মিল বন্ধ হয় ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই। মিলের ৬৬৭ জন শ্রমিক-কর্মচারীর মধ্যে ৩৬৫ জনের প্রায় ১১ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। শিরোমনি এলাকার জুট স্পিনার্স বন্ধ হয় ২০১৬ সালে। মিলের স্থায়ী ও অস্থায়ী ১ হাজার ২০০ জন শ্রমিকের পাওনা রয়েছে ৩৭ কোটি টাকা। অবশ্য মাত্র ৭০ থেকে ৮০ জন শ্রমিক নিয়ে মিলটি সম্প্রতি আংশিক চালু হয়েছে।
বেসরকারি পাট, সুতা, বস্ত্রকল শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল্লাহ তারেক অভিযোগ করেন, মালিকপক্ষ পাটকল সচল রাখার জন্য ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিলেও তা অন্য ব্যবসায় ব্যয় করেছেন। ফলে মিলগুলোর দুরবস্থা কাটেনি। অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় ইতোমধ্যে কয়েকজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
নিউজপ্রিন্ট ও হার্ডবোর্ড মিল
নগরীর খালিশপুরে ভৈরব নদের তীরে ১৯৫৭ সালে গড়ে ওঠে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল। লোকসানের অজুহাতে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর মিলটি বন্ধ ঘোষণা করা হলে বেকার হন ৩ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। মিলের জমিতে বিভিন্ন সময় কাগজকল, সার কারখানা ইত্যাদি নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে খালি পড়ে আছে মিলের ৩৭ একর জমি। একই এলাকায় ১৯৬৫ সালে স্থাপিত খুলনা হার্ডবোর্ড মিল বন্ধ করে দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর। বেকার হয়ে পড়েন এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। তখন থেকে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে ১০ একর জমি। অব্যবহৃত থাকায় নষ্ট হয়ে গেছে মিল দুটির বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি।
দাদা ম্যাচ ও টেক্সটাইল মিলসহ ৪ প্রতিষ্ঠান
বয়রা এলাকায় ১৯৩১ সালে খুলনা টেক্সটাইল মিল স্থাপিত হয়। ১৯৯৩ সালের ১৯ জুন লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৎকালীন সরকার মিলের দেড় সহস্রাধিক শ্রমিক-কর্মচারীকে ছাঁটাই এবং মিলটি বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর থেকে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে মিলের ২৬ একর জমি। বিভিন্ন সময় মিলের জমিতে টেক্সটাইলপল্লি, থিম পার্ক ইত্যাদি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। রূপসা স্ট্যান্ড রোডে ১৮ একর জমিতে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছিল ১৯৫৫ সালে। ২০১০ সালে বন্ধ করে দেওয়ায় বেকার হয়ে পড়েন প্রায় ১ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, দুটি প্রতিষ্ঠানের এত মূল্যবান জমি দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। জমি এভাবে ফেলে না রেখে দ্রুত মানুষের কর্মসংস্থান হয়– এমন প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি।
নগরীর লবণচরা এলাকার বিসিআইসির কোরাইশি স্টিল মিল বন্ধ হয়ে যায় ১৯৮৪ সালের ২৯ মার্চ। একই এলাকার ব্যক্তিমালিকানাধীন খুলনা অক্সিজেন ২০০৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ফুলতলা এলাকায় একটি টোব্যাকো কোম্পানি ও বেশ কয়েকটি রাইস মিল বন্ধ হয়ে গেছে।
চিংড়ি রপ্তানিকারক কারখানা
হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি ব্যাপক লাভজনক হওয়ায় আশির দশকে খুলনায় গড়ে ওঠে প্রায় ৪০টি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এসব কারখানা একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক হুমায়ুন কবীর জানান, বর্তমানে ২০টির মতো কারখানা আংশিক চালু আছে। নিয়মিত বিদেশে রপ্তানি করছে মাত্র ৫ থেকে ৬টি প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলো বছরে দু-একবার রপ্তানি করে এবং সেগুলোর অবস্থা রুগ্ণ।
তিনি জানান, কাঁচামাল ও পুঁজি সংকট, ব্যাংক ঋণ পেতে জটিলতা, দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। অসংখ্য শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন।
২০টি লবণ মিল বন্ধ
খুলনায় লবণ শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। ভৈরব ও রূপসা নদীর তীরে গড়ে ওঠে ২৮টি মিল। কিন্তু ১৯৯৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে ২০টি মিল বন্ধ হয়েছে। মিল মালিকরা জানান, খুলনার লবণ শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বন্যা, লোকসান, পুঁজি সংকট, ব্যাংক ঋণ পেতে জটিলতা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং বড় মিলের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা জানান, চালু ৮টি মিলের অবস্থাও ভালো নয়। কাঁচামাল এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে এগুলো বিপাকে।
শিল্পাঞ্চলে কমেছে জনসংখ্যা
২০১১ সালের জনশুমারিতে খালিশপুর শিল্প এলাকার জনসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার ২৯৯ জন। ২০২২ সালের শুমারিতে জনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৪ জনে। ১১ বছরের ব্যবধানে জনসংখ্যা কমেছে ১৩ হাজার ৬১৫ জন। এ ছাড়া আটরা শিল্প এলাকায় জনসংখ্যা কমেছে ৯৪৪ জন। অথচ খুলনার অন্যসব এলাকায় ১১ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে।
পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা বলেন, এক সময় শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত ছিল খুলনা। কিন্তু বেশির ভাগ শিল্পকারখানাই এখন বন্ধ। বেশ কয়েকটি পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শ্রমিক পরিবার এলাকা ছেড়ে তাদের নিজ নিজ জেলায় ফিরে যাওয়ায় জনসংখ্যা কমেছে।
দুই বছরে গড়ে উঠেছে
মাত্র সাতটি প্রতিষ্ঠান
পদ্মা সেতু চালুর প্রেক্ষাপটে নতুন শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার যে স্বপ্ন খুলনার মানুষ দেখেছিল, তা পূরণ হয়নি। বন্ধ মিলকারখানা চালু করতে যেমন সরকারি ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ নেই, তেমনি বেসরকারি পর্যায়েও তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) খুলনা বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে খুলনায় মাত্র সাতটি ছোট ও মাঝারি শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, যাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। এ সময়ে ভারী কোনো শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, তাদের ধারণা ছিল, পদ্মা সেতু চালুর পর খুলনায় গার্মেন্টসহ নতুন বড় শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। বন্ধ শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালুর ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর গত দুই বছরে নতুন বড় কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি।
বিডার পরিচালক প্রণব কুমার রায় বলেন, শিল্পকারখানা গড়ে না ওঠার অন্যতম কারণ পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ ও বিমানবন্দর না থাকা। পদ্মা সেতু চালুর পর এখনও বিনিয়োগকারীদের তেমন তোড়জোড় দেখা যায়নি। বিমানবন্দর না থাকায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসতে আগ্রহী হয় না। এ ছাড়া ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির জটিলতায়ও অনেকে আগ্রহী হচ্ছে না।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক চৌধুরী মিনহাজ উজ জামান সজল বলেন, খুলনায় এমনিতেই শিল্প উদ্যোক্তা কম। তার ওপর গ্যাস সরবরাহ ও বিমানবন্দর না থাকায় অন্যান্য জেলার বিনিয়োগকারীরাও এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ যেসব এলাকায় গ্যাস সরবরাহ রয়েছে, সেখানকার তুলনায় খুলনায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালাতে খরচ অনেক বেশি হয়।