দেশে মূল্যস্ফীতির হার এবং খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি এখন বাংলাদেশে ব্যাংকের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক খাতে ছয় মাস ধরে খেলাপি ঋণের হার যেভাবে বেড়েছে, তা এখন এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে; যা ব্যাংক খাতের আর্থিক ভিত্তিকে দুর্বল করে তুলেছে। তারল্য সংকট বাড়িয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে শক্তিশালী ও সুনিয়ন্ত্রিত একটি ব্যাংক খাত গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে এ খাতে গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধার করার বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং গ্রাহকদের মধ্যে সুশাসনের বিষয়টি তুলে ধরা হচ্ছে। যাতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার প্রতি গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা সহজ হয়। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণেও বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বুধবার প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ত্রৈমাসিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেশের সার্বিক অর্থনীতি, আর্থিক খাত, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রতি তিন মাস পর প্রকাশিত হওয়ার কথা থাকলেও বিদায়ি গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়ে এসব খাতের নেতিবাচক চিত্রগুলো আড়াল করতে অনেক দেরিতে প্রকাশ করতেন। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতসহ সব খাতের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যে কারণে এখন অর্থনীতির অনেক নেতিবাচক চিত্র বেরিয়ে আসছে। একই সঙ্গে প্রতিবেদনটিও হালনাগাদভাবে প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ কারণে এবার জানুয়ারি-মার্চ ও এপ্রিল-জুন-এ দুই প্রান্তিকের তথ্য-উপাত্ত একসঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বরে দেশের কিছু অংশে বন্যার কারণে আগামী ত্রৈমাসিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা মন্থর হতে পারে। এ ক্ষতি মোকাবিলা করে সামষ্টিক অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারসহ একটি ব্যাপক সংস্কার পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যা আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আসা না পর্যন্ত মুদ্রানীতিতে কঠোরতা অব্যাহত রাখা হবে। বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলার জন্য কয়েকটি সংস্থা থেকে বৈদেশিক সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি রেমিট্যান্সের শক্তিশালী প্রবাহ ডলার বাজার স্থিতিশীল করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এতে টাকার মান স্থিতিশীল রয়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসছে। জুন পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৮ দশমিক ২ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার এখনো ডাবল ডিজিটে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রেমিট্যান্স প্রবাহে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির কারণে ভোগের চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আর্থিক কঠোরতা এবং বিনিময় হারের স্থিতিশীলতার কারণে আমদানি ব্যয়কে স্থিতিশীল রেখেছে। এতে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বিগত ঈদুল আজহাকে ঘিরে ভোক্তার চাহিদা বৃদ্ধি এবং সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। এছাড়া গত এপ্রিলে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র দাবদাহ এবং মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এতে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এসব কারণেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিনিময় হারের অস্থিরতা, বৈশ্বিক পণ্যের মূল্যে অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক সরবরাহব্যবস্থায় বাধা এবং মুদ্রানীতির কঠোরতার কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক খাত অসংখ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
গত দুই প্রান্তিকেই অর্থনীতিতে সামগ্রিকভাবে একটি মন্থর চিত্র ফুটে উঠেছে। রাজস্ব আয় কমার কারণে সরকারি ব্যয়ও হ্রাস করতে হয়েছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগেও মন্দা। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ধীর হয়েছে।
প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে বলা হয়, গত ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ শতাংশ। গত মার্চে তা ১১ দশমিক ১১ শতাংশে উন্নীত হয়। জুনে তা আরও বেড়ে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এক দশকের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। খেলাপি ঋণের এত ঊর্ধ্বগতি ব্যাংক খাতের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ।
বাংলাদেশ ব্যাংক এ খাতের দুর্বলতার মূল কারণগুলো শনাক্ত করে সেগুলো মোকাবিলা করা এবং সামগ্রিক উন্নতির লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এ উদ্যোগ সরকারের গৃহীত বৃহত্তর সংস্কার কর্মসূচির একটি অংশ। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা, দেশের সার্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে গতিশীল করাই লক্ষ্য। এ সংস্কারের অংশ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে দুর্নীতিতে জড়িত ব্যাংক পরিচালকদের বরখাস্ত করেছে।