গ্যাস সরবরাহ না থাকায় দীর্ঘদিন থেকে দেশের তিনটি সার কারখানা বন্ধ। অপরদিকে ডলার সংকটে পরিকল্পনা অনুযায়ী সার আমদানি করতে পারছে না সরকার। সারের চাহিদা মোকাবিলা করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরিয়ার পাশাপাশি অন্য সার আমদানিতেও অচলাবস্থা চলছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে খাদ্যশস্য উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হতে পারে। ডলার সংকটের পাশাপাশি গত কয়েক মাসের প্রশাসনিক দুর্বলতায় যথাসময়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় সার ব্যবস্থাপনা জটিল অবস্থায় চলে গেছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ইউরিয়া সারের উৎপাদন, আমদানি, বিতরণ ও মজুত বিষয়ে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় নাজুক পরিস্থিতি উঠে আসে। সভায় বিসিআইসি চেয়ারম্যান জানান, নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ না পাওয়া গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিজস্ব সার কারখানায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে ৬ লাখ ৪৬ হাজার টন। উৎপাদন ঘাটতি ছিল সাড়ে তিন লাখ টনেরও বেশি।
কার্যপত্রে বলা হয়, গত জুলাই মাস থেকে ‘মিনি পিক সিজন’ শুরু হয়, যা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে। এ সময়ে সারের চাহিদা ৬ লাখ ৭৮ হাজার টন। কিন্তু বর্তমানে সারের মজুত রয়েছে মাত্র ৪ লাখ ৩৫ হাজার টন। অক্টোবর ও নভেম্বর-দুই মাসে সারের চাহিদা প্রায় ৪ লাখ টন। এরপর ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে ‘পিক সিজন’, যা চলমান থাকবে মার্চ মাস পর্যন্ত। এ সময়ে সারের চাহিদা থাকে প্রায় ১৪ লাখ টন। সে হিসাবে মার্চ মাস পর্যন্ত দেশে সারের চাহিদা দাঁড়াচ্ছে ১৮ লাখ টন।
সভায় বিসিআইসি চেয়ারম্যান জানান, বর্তমানে শুধু ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানা ও শাহজালাল সার কারখানা উৎপাদনে রয়েছে। গ্যাস সরবরাহ না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে যমুনা সর কারখানা, সিইউএফএল সার কারখানা ও আশুগঞ্জ সার কারখানা বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, একই সঙ্গে ডলার সংকটের কারণে পরিকল্পনামাফিক সার আমদানি করা যাচ্ছে না।
সভায় বিসিআইসির ক্রয় বিভাগের উপস্থাপনায় বলা হয়, দেশীয় কারখানায় সার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) চুক্তির আওতায় সার আমদানি বাড়িয়ে এ ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হলেও চলমান ডলার সংকটে তা সম্ভব হয়নি। ডলার সংকটে এলসি খোলা ও সারের মূল্য পরিশোধ স্বাভাবিক না থাকলে এ মজুত আরও কমবে। সভায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বলেন, সার্বিক পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, আগামী জানুয়ারি মাস থেকেই সারের সংকট তৈরি হবে। তাই এখনই সারের মজুত বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অপশনাল সার বা টেন্ডারের মাধ্যমে আমদানির প্রস্তাব দেন তিনি।
সভায় বিসিআইসি পরিচালক (বাণিজ্যিক) বলেন, আসন্ন পিক সিজনে সারের মজুত নিয়ে তারা খুবই উদ্বিগ্ন। তাই গত জানুয়ারি থেকে বন্ধ থাকা সার কারখানাগুলো চালু করতে গ্যাস সরবরাহের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। অপরদিকে পর্যাপ্ত ডলার না পাওয়ার কারণে সময়মতো এলসি খোলা ও মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় জিটুজি চুক্তির আওতায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফার্টিগ্লোব থেকে সার আমদানি পিছিয়ে গেছে। এলসি অ্যাড কনফার্ম না হওয়া প্রতিষ্ঠানটি থেকে এখনও দুই লটের সার আমদানি আটকে আছে।
সভায় বিসিআইসির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) বলেন, সম্প্রতি তিনটি লটের মূল্য পরিশোধে দেরি হওয়ায় কাতারের মুনতাজাত ১০ হাজার ২৮৫ ডলার সুদ দাবি করেছে। এটি নিষ্পত্তি না হলে সংস্থাটি থেকে সার আমদানি বিঘ্নিত হতে পারে। একইভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফার্টিগ্লোবের ক্ষেত্রে বিল পরিশোধে কয়েকবার দেরি হয়। এতে করে সংস্থাটি মনোনীত ব্যাংক মাশরেক ব্যাংক, আবুধাবি এলসি কনফার্মেশন করতে অনীহা প্রকাশ করে। অনেক অনুরোধে এলসি কনফার্মেশন ছাড়াই সার সরবরাহ করতে সম্মত হয় ফার্টিগ্লোব। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আন্দোলন ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সাময়িকভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সার সঠিক সময়ে জাহাজীকরণ না হওয়ায় ১ লাখ ৭ হাজার ডলার ডেমারেজ হয়েছে। এ ডেমারেজ পরিশোধের জন্য পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান চাপ দিচ্ছে। ফার্টিগ্লোব এলসি কনফার্মেশন ছাড়া সার দেওয়া বন্ধ রেখেছে।
বৈঠকে সভাপতি সার আমদানিতে এলসি খোলা, অ্যাড কনফার্মেশন ও মূল্য পরিশোধের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী, জনতা, অগ্রণী এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রতিনিধির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা বলেন, সব সময় সার আমদানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু বিদ্যমান ডলার পরিস্থিতিতে এলসি খুলতে ও মূল্য পরিশোধে কখনও কখনও বিলম্ব হয়। চাহিদার তুলনায় ডলার সরবরাহ কম থাকায় তাদের কিছু করার থাকে না।
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি জানান, মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে চলমান ডলার পরিস্থিতি তাদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণের লক্ষ্যে আপাত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। তবে মূল্য পরিশোধে অনেক ক্ষেত্রে বিলম্ব হলেও বাংলাদেশ বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি হয়নি। এ ক্ষেত্রে সবার দায়িত্ব বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা। একই সঙ্গে নিজ নিজ ব্যাংক থেকেই মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে সমকালের পক্ষ থেকে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল সমকালকে বলেন, বারবার চিঠি দিয়েও কারখানায় গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত ডলার না পাওয়ায় আমদানি কার্যক্রমেও উন্নতি হয়নি। এ বিষয়গুলোতে সরকার মনোযোগ না দিলে অবস্থা জটিল পর্যায়ের দিকে যাবে বলেও জানান তারা।
সার আমদানিতে ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে গত দুই মাসে অন্তত অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। অর্থ উপদেষ্টার কাছে সম্প্রতি লেখা এক চিঠিতে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশকে সার সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮ কোটি মার্কিন ডলার বকেয়া পড়েছে। এ কারণে চীন, কানাডা, সৌদি আরব, মরক্কো– এ চার দেশের রপ্তানিকারকরা বাংলাদেশকে সার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি বকেয়া বিলের অর্থ চেয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাপ প্রয়োগ করছে তারা। এ অবস্থার উন্নতি না হলে আগামীতে সার সংকটসহ বহুমাত্রিক সমস্যা দেখা দেবে।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান সমকালকে বলেন, খাদ্য নিরাপত্তায় সার সরবরাহে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে যে মজুত রয়েছে, তা দিয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো সমস্যা হবে না। ইতোমধ্যে বকেয়ার অধিকাংশই পরিশোধ করা হয়েছে। আমদানি কার্যক্রম দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।