বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগ নিয়ে ভয়াবহ এক কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস হয়েছে। এর সঙ্গে খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান এবং বিতর্কিত দুজন যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও আলী আযম সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য ফুটে উঠেছে। সেই সিনিয়র সচিবের সঙ্গে এক যুগ্ম সচিবের হোয়াটসঅ্যাপে সংবেদনশীল কথোপকথনে সম্প্রতি জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে উঠে এসেছে বড় ধরনের আর্থিক লেনদেনের তথ্যও। যে কথোপকথনের কিছু স্ক্রিনশট রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মহলেও ঘুরপাক খাচ্ছে, যা নিয়ে তোলপাড় চলছে খোদ প্রশাসনের ভেতরেও। এ কথোপকথনের অতি সংবেদনশীল কিছু অংশের স্ক্রিনশট কালবেলার হাতে এসেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশের দায়িত্ব নেওয়া নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে বিপাকে ফেলতে বড় ধরনের আর্থিক সুবিধা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে ডিসি ‘নিয়োগকাণ্ড’ ঘটানো হয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অনেকে বিষয়টিকে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন।
এ ব্যাপারে জানতে ফোন করা হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান রিসিভ করেননি। পরে এসএমএস করা হলে জবাবে তিনি লেখেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না’। অন্যদিকে যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে নানাভাবে চেষ্টা করা হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সম্প্রতি এক যুগ্ম সচিবের কক্ষ থেকে ৩ কোটি টাকার একটি চেক এবং ডিসি নিয়োগ সংক্রান্ত কিছু চিরকুট উদ্ধার সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক কালবেলা। সাড়া জাগানো সেই প্রতিবেদন নিয়ে তোলপাড় তৈরি হলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। ঘটনা তদন্তে এক সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অবশেষে মঙ্গলবার রাতে যে কর্মকর্তার দিকে সন্দেহের আঙুল উঠেছিল, সেই যুগ্ম সচিবকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও এর আগে সংবাদ সম্মেলন ডেকে কালবেলার ওই প্রতিবেদনকে ‘গুজব’ ও ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে দাবি করেছিলেন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২৮ আগস্ট থেকেই তাদের (মোখলেস-জিয়া) মধ্যে কথোপকথনের কিছু তথ্য হস্তগত করে সরকারের বিভিন্ন মহল। আলাপচারিতায় সিনিয়র সচিব যুগ্ম সচিব জিয়াকে হোয়াটসঅ্যাপে কথা না বলে সরাসরি কথা বলতে বলেন। কারণ এখন তিনি সংবেদনশীল চেয়ারে আছেন এবং তাকে গোয়েন্দারা নজরে রাখছে বলেও উল্লেখ করেন। কিন্তু সরকার পতনের পর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগের মতো ‘সক্রিয় নয়’ দাবি করে ড. জিয়া সিনিয়র সচিবকে আশ্বস্ত করেন। এরই মধ্যে তারা হোয়াটসঅ্যাপ কলেও কথা বলেন। আলাপচারিতার একটি খুদেবার্তায় (মেসেজ) ডিসি নিয়োগ নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে আনা হয়েছে এবং এখন কেউ কিছু করতে পারবে না বলে সচিবকে আশ্বাস দেন জিয়া। একটি মেসেজে সচিব নিজেকে ‘নির্লোভ’ দাবি করে মাত্র ৫ কোটির একটি আবদার করেন। জিয়া তাকে সুখবর দিয়ে বলেন ১০ কোটি রাখার কথা। এতে সন্তুষ্ট হয়ে সচিব তাকে বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার যেটা ভালো মনে হয়।’ তবে টাকা-পয়সার প্রতি নিজের তেমন লোভ নেই বলেও জিয়াকে জানান সচিব। আলাপে সচিব গোয়েন্দা সংস্থাকে ‘গিরগিটি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন জিয়াকে। এ বিষয়ে জিয়া ওই সিনিয়র সচিবকে অভয় দিয়ে কোনো টেনশন না নিতে আশ্বস্ত করেন। আলাপে সচিব অর্ধেক ডলারে আর বাকিটা তার লোকের কাছে নগদে (ক্যাশ) দেওয়ার জন্যও বলেন।
তারা আলাপকালে ডিসির জন্য নামগুলো গোপনে টাইপ করে নিয়ে আসতে বলেন জিয়াকে। তবে ডিসি নিয়োগ নিয়ে ‘বিদ্রোহ’ এড়াতে চারজনের নাম নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন সচিব। পরে প্রজ্ঞাপনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ জেলায় ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর ডিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে নিযুক্ত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের ওপর দায় চাপানো; জনপ্রশাসনের এপিডির অতিরিক্ত সচিবকে বাইরে রাখা এবং এসএসবির বিশেষ সদস্য আকমল হোসেন আজাদের বিষয়টির প্রসঙ্গও উঠে আসে। এ ছাড়া ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন কবে হবে, সেটিও উঠে আসে এবং তাদের কথোপকথন অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওই দিনেই ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন হয়।
জানা গেছে, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই ধাপে ৫৯ জেলা প্রশাসক প্রত্যাহার করে নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ব্যাপক যাচাই-বাছাই শেষে গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দুই ধাপে জারি প্রজ্ঞাপনে সেসব জেলায় ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু এই নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা অভিযোগ আসতে থাকে। অভিযোগ ওঠে ‘আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে’ প্রশাসনের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা পতিত সরকারের আমলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এবং আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের ডিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। বিষয়টি তুলে ধরে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার হওয়া কর্মকর্তারা ব্যাপক হট্টগোল করেন। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৯ জেলার ডিসির প্রজ্ঞাপন বাতিল এবং চারজনকে রদবদল করে পুনরায় প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
বৈষম্যের শিকার হওয়া কর্মকর্তাদের দাবি, দুই যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও আলী আযমের নীল নকশাতেই আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের টাকার বিনিময়ে ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ, হট্টগোলের ঘটনায় যুগ্ম সচিব আলী আযমকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে সিলেটে বদলি করা হয়। অন্যদিকে, হট্টগোলের ঘটনায় সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড এসএসবির বিশেষ সদস্য ও স্বাস্থ্য সচিব আকমল হোসেন আজাদকে প্রধান করে এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশে হট্টগোলে জড়িত থাকার অভিযোগে মন্ত্রণালয় ১৭ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্য জানান জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব, যা নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত পর্যালোচনায় গত মঙ্গলবার রাতে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিএএসএ)। রাজধানীর বিয়ামে হওয়া ওই সভা থেকে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের জন্য সরকারকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এমন প্রেক্ষাপটে আরেক যুগ্ম সচিবের কথোপকথনের তথ্য ফাঁস হলো।
ফাঁস হওয়া মোবাইলের স্ক্রিনশট নানাভাবে পর্যালোচনা এবং অনুসন্ধান করে কালবেলা। এতে দেখা যায়, এক প্রান্তে জিয়াউদ্দিন আহমেদ স্রেডা। তিনি এর আগে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) উপপরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। এজন্য তার নামের পাশে ‘স্রেডা’ সংকেতটি থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কথোপকথনে যে মোবাইল নম্বর দেখা যাচ্ছে, সেটিরও অনুসন্ধান করে দেখা যায়, তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদের নামে নিবন্ধিত। নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সার্ভারে তার এই মোবাইল নম্বরটিই দেওয়া আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন করপোরেশনের (বিটিআরসি) অনুসন্ধানে মোবাইল নম্বরটি ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদের নামেই রেজিস্ট্রেশন করার তথ্য পাওয়া যায়। পুলিশের এলআইসি শাখার তথ্যও বলছে নম্বরটি ড. জিয়াউদ্দিনের। অন্য প্রান্তে কার সঙ্গে কথা হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কথোপকথনের ধরন ও সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে অন্য প্রান্তের ব্যক্তি ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানের বলে সহজেই অনুমান করা যায়। আর আলাপচারিতার সেই ছবিগুলো একটি আইফোনের বলে এক্সপার্টদের কাছে নিশ্চিত হয়েছে কালবেলা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত ১৩ আগস্ট ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা ড. জিয়াউদ্দিনকে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসনে ন্যস্ত করে সরকার। ওইদিনই তিনি যোগদান করেন। এরপর ১৮ আগস্ট আরেক দফা পদোন্নতি দিয়ে তাকে যুগ্ম সচিব করা হলে ওইদিনই তিনি যোগদান করেন। আর সিনিয়র সচিবের সঙ্গে তার আলাপচারিতার তথ্য তার পরের। অন্যদিকে অবসর থেকে ফিরে ২৮ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান ’৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. মোখলেস উর রহমান। ওইদিনই তিনি যোগদান করেন।
খুদেবার্তায় ভয়ানক তথ্য: হোয়াটসঅ্যাপের খুদেবার্তার আলাপচারিতা থেকে দেখা যায়, মোখলেস উর রহমানের যোগদানের পরই তাকে অভিনন্দন জানান ড. জিয়া। ওইদিন রাত ৯টা ৩ মিনিটে সচিবকে ড. জিয়া লিখেছেন, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার, অভিনন্দন স্যার।’ ৯টা ১৭ মিনিটে সচিব জবাব দেন ‘ধন্যবাদ জিয়া। কাল একবার এসো দেখা কইরো। সামনাসামনি কথা বলব।’ জিয়া লেখেন, ‘জি স্যার।’ সচিব আবার লেখেন ‘কাল একবার ওইখানে আইসো।’ জবাবে জিয়া বলেন, ‘অবশ্যই স্যার।’ রাত ৯টা ২৮ মিনিটে জিয়া বলেন, ‘স্যার সবাই প্রশংসা করছে।’ ৯টা ৪২ মিনিটে সচিবের জবাব, ‘কী বলে?’ জিয়ার জবাব, ‘স্যার সবাই বলে মোখলেস যোগ্য লোক, মোখলেস Harvard থেকে পড়ে আসছে।’ এরপর ৯টা ৪৪ মিনিটে জিয়া হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলেও সিনিয়র সচিব রিসিভ করেননি। পরে ৯টা ৫৬ মিনিটে সচিব কল ব্যাক করে জিয়ার সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলেন। এ সময় কী কথা হয়েছে, তা জানা যায়নি। এরপর ৩০ আগস্ট শুক্রবার রাত ৮টা ১০ মিনিটে সচিব জিয়াকে লেখেন, ‘যা করবা খুব সাবধানে করবা, হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া অন্য নম্বরে টেক্সট দিবা না।’ ৮টা ১৬ মিনিটে জিয়ার প্রতিউত্তর, ‘ঠিক আছে স্যার, আমি গুছাই আসছি। এখন কেউ কিছু করতে পারবে না।’ ৮টা ২১ মিনিটে সচিব বলেন, ‘আসলে আমার তেমন দরকার নাই 5c হলেই হবে।’ জবাবে জিয়া বলেন, ‘স্যার আপনার জন্য 10c রাখব।’ এবার সচিব বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার যেটা ভালো মনে হয়। টাকা-পয়সার প্রতি তেমন লোভ নাই আমার। গিরগিটিগুলোর প্রতি খেয়াল রাইখো।’ জিয়া বলেন, ‘স্যার আমি সতর্ক আছি, আপনি টেনশন নিয়েন না।’ রাত ৮টা ৩২ মিনিটে সচিব আবার লেখেন, ‘ডলারে দিও অর্ধেক 5c; বাকিটা ক্যাশ দিও আমার লোকের কাছে।’ জবাবে জিয়া বলেন, ‘স্যার আপনি যেভাবে বলবেন।’ সচিব বলেন, ‘হোয়াটসঅ্যাপে তো প্রবলেম নাই।’ জিয়ার জবাব, ‘না স্যার। হাসিনাই পারে নাই আর এখন তো গোয়েন্দাগুলো দুর্বল হয়ে আছে।’ এরপর সচিব ৮টা ৩৯ মিনিটে জিয়াকে কল করেন এবং এ সময় তাদের মধ্যে তিন মিনিট কথা হয়। ৯টা ১৮ মিনিটে জিয়া সচিবকে বলেন, ‘স্যার একটা পক্ষ ৫০/৫২টা চায়। ওদের এটা দিতে হবে। নইলে ঝামেলা হবে।’ এরপর ৯টা ২০ মিনিটে সচিব জিয়াকে কল করে ৫০ সেকেন্ড কথা বলেন। ৯টা ২৬ মিনিটে জিয়া এবার লেখেন, ‘ওরা ২০০ দিবে।’ ‘ওরা জানতে চাইছে এটা কোথায় নিবেন? সিঙ্গাপুরে নাকি থাইল্যান্ডে নিবেন?’ mode of payment কি হবে?’ সচিব লেখেন, ‘তুমি আর আযম ঠিক করে নাও।’ এরপর ৯টা ৪১ মিনিটে জিয়া সচিবকে কল দিলেও কথা হয়নি। পরে ১০টা ২২ মিনিট ও ১০টা ২৭ মিনিটে সচিব জিয়াকে দুইবার কল দিলেও রিসিভ হয়নি। এরপর ১০টা ৩১ মিনিটে জিয়া এবার লেখেন, ‘স্যার আমি গ্যারান্টি।’ সচিবের জবাব, ‘পারলে ফাইভ সি (পাঁচ কোটি) আগে দিও।’ জিয়া বলেন, ‘ঠিক আছে স্যার।’ এবার সচিব বলেন, ‘গোপনে টাইপ করায় নিয়ে আইসো, আমি পাস করাই দিব, ওদের মধ্য থেকে তিন-চারজনকে রাইখো।’ জিয়া বলেন, ‘জি স্যার, …কে রাখছি।’ সচিব আবার বলেন, ‘খুব ভোরে গোপনে আইসো।’ জিয়ার জবাব, ‘ঠিক আছে স্যার।’
১ সেপ্টেম্বর রোববার ভোর ৭টা ১৩ মিনিটে জিয়া লেখেন, ‘স্যার সালাম।’ ৭টা ২২ মিনিটে সচিবের জবাব, ‘বলো।’ জিয়া বলেন, ‘স্যার সব রেডি।’ সচিব বলেন, ‘very good. clear all payments 5th september, I will do their GO asap, probably on september 9 and 10’ জিয়ার জবাব, ‘অবশ্যই স্যার।’
২ সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল ৮টা ৭ মিনিট ও ১০ মিনিটে সচিব জিয়াকে দুবার কল দিলেও রিসিভ হয়নি। এরপর জিয়া সকাল ৮টা ৩৩ মিনিটে সচিবকে কল দিলে তাদের মধ্যে ৭ মিনিট কথা হয়। সকাল ৮টা ৫২ মিনিটে সচিব আবার লেখেন, ‘ওখানে আসতে পারবা রাতে?’ জিয়ার জবাব, ‘জি স্যার।’ সচিব বলেন, ‘ওদিকে কি অবস্থা, আপডেট দাও।’ এ সময় জিয়া বলেন, ‘আমি আর আযম মিলে সব ঠিক করে ফেলেছি স্যার, আপনি টেনশন নিয়েন না, সিস্টেমে এপিডিকে কাজ দিয়ে বাইরে রাইখেন। উনি জেনো ঝামেলা করতে না পারে।’ সচিব বলেন, ‘সবকিছু ঠিকঠাক করো আর তুমি ওরে নিয়ে টেনশন কইরো না, ওরে সিস্টেমে ফেলে দিব। আর কেউ কিছু বললে আমার নাম বলবা না, ‘আলী ইমাম স্যার আর আহসান কিবরিয়ার নাম বলবা। বলবা যে, উনারা সবকিছু ঠিকঠাক করে। ডিসিও উনারা বানাবে। কারণ পোলাপাইন উনাদের কাছে পৌঁছতে পারবে না।’ জিয়া বলেন, ‘জি স্যার। এখন আকমল স্যারকে হাতে রাখবেন। একটু সাপোর্ট দরকার। উনি তো প্রথম দিন অফিসারদের আদমজী বলে গালি দিছিল। এই কারণে অফিসাররা উনার ওপর বিরক্ত। একটু উসকাইয়া দিলে উনি চাপে থাকবেন। তাহলে তার ওপর কিছু চালাইয়া দেওয়া যাবে। অফিসাররা মনে করবে যে, উনি আগে থেকে ওদের ওপর অসন্তুষ্ট, এজন্য ওদের দেয় নাই।’ সচিব লিখেন, ‘ঠিক আছে এগুলো নিয়ে ভেবো না, আমি মিয়া পুরাতন খেলোয়াড়, তোমরা তোমাদের কাজ করো।’ জিয়া বলেন, ‘জি স্যার।’
সচিব বলেন, ‘দেখলাম তোমরা আহসান কিবরিয়াকে কীভাবে বিতর্কিত করে ফেলছ। এটা অবশ্য সুবিধা হইছে আমাদের জন্য।’ জিয়া বলেন, ‘জি স্যার।’ আপনি স্যার আমার আর আযমের ওপর আস্থা রাখেন।’ সচিব বলেন, ‘ok. জিয়া বলেন, ধন্যবাদ স্যার।’ এরপর ওইদিন রাত ৮টা ১ মিনিটে সচিব জিয়াকে কল দিলেও রিসিভ হয়নি। পরে জিয়া রাত ৯টা ৫ মিনিটে সচিবকে কল করে ১২ সেকেন্ড এবং ৯টা ১৩ মিনিটে ৫৯ সেকেন্ড কথা বলেন। সূত্রমতে ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি উইয়ের যুগ্ম সচিব এবং জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমানের গ্রামের বাড়ি পাশাপাশি জেলায় হওয়ার সুবাদে আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ। আরেক বিতর্কিত যুগ্ম সচিব আলী আযম ও ড. জিয়া খুবই ঘনিষ্ঠ হিসেবে প্রশাসনে পরিচিত।
প্রসঙ্গত গত ২৪ সেপ্টেম্বর ‘৩ কোটি টাকার ক্যাশ চেক দিয়ে ডিসির পদায়ন!’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক কালবেলা। এতে যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিনের কক্ষ থেকে ওই চেক এবং ডিসি নিয়োগ সংক্রান্ত ইঙ্গিতপূর্ণ কিছু তথ্য সংবলিত চিরকুট পাওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়। নওগাঁর ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আব্দুল আউয়ালের পক্ষে ওই চেক লেনদেন হয়। যদিও ওই চেক নগদায়ন হয়নি। চেকদাতা মীর্জা সবেদ আলী নামে এক ব্যক্তি পদ্মা ব্যাংকের রাজধানীর লক্ষ্মীবাজার শাখার ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে ওই চেক দিয়েছিলেন। বিষয়টি অনুসন্ধানে চেকদাতা সবেদ আলী কালবেলার কাছে স্বীকারও করেন। তবে নওগাঁর ডিসি আব্দুল আউয়াল বিষয়টি অস্বীকার করেন।
একই দিন দৈনিক সমকাল এবং যুমনা টিভি একই বিষয়ে বিশদ বিবরণ তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারপরও কালবেলার প্রতিবেদন যাচাই ও সত্যতা নিশ্চিতে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেখানে বক্তব্যের জন্য কালবেলার প্রতিবেদককে দুই দফা তলব করায়। প্রতিবেদক তদন্ত কমিটির প্রতি সম্মান জানিয়ে কমিটির সামনে হাজির হয়ে প্রতিবেদনের স্বপক্ষে তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেন। এ ছাড়া বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টিফোরসহ বিভিন্ন মিডিয়াও এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গত সোমবার জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান একটি সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ‘ওই চেকটি ছিল একটি ভুয়া চেক।’ কালবেলা ভাইরাল হওয়ার জন্য এরকম নিউজ করেছে এবং সেজন্য পত্রিকাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তথ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেবেন বলেও জানান। তবে তিনি ভুয়া বললেও ওই চেকের অ্যাকাউন্ট ২০২৩ সালে দুই হাজার টাকা জমা দিয়ে খোলা হয়। বর্তমানে ওই ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা নেই বলে নিশ্চিত করা হয়। আর হিসাব খোলার সময় কেওয়াইসি ফরমটি যথাযথভাবে পূরণ করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। সেজন্য অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে কেওয়াইসি ফরম যাতে যথাযথভাবে পূরণ হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান; একই সঙ্গে চেকদাতা ওই ব্যক্তির বিপক্ষে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি নির্দেশনা দেন তিনি। আর ডিসি-কাণ্ডে নাম আসা যুগ্ম সচিব আলী আযমকে এরই মধ্যে সিলেটে বদলি এবং বাকিদেরও বদলি করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন। এমন প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার রাতে অপর যুগ্ম সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদকে জনপ্রশাসন থেকে সরিয়ে সাভারে বদলি করা হয়।