বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। দেশীয় এই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল (সুতা) তৈরি হয় তুলা থেকে। তবে চাহিদার তুলনায় তুলা উৎপাদনে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৮৯ শতাংশই চলছে আমদানি নির্ভর। তুলা শিল্পের এমন পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দুষছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ৫২ বছরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি তুলা শিল্প। এমন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। মাঠপর্যায়ের দায়িত্ব দিতে হবে দক্ষ ও অভিজ্ঞ অফিসারদের।
এদিকে তুলা আমদানিতে ব্যাপক ভোগান্তি ও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে দেশীয় তুলা আমদানির সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে। চাহিদা অনুযায়ী টাকা নিয়েও অনেক দেশ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তুলা সরবরাহ করছে না। তারা উচ্চমান দেখিয়ে নিুমানের তুলা পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে অনেক স্পিনিং মিলের মালিকরা হয়রানির শিকার ও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক খোরশেদ আলম যুগান্তরকে বলেন, সঠিক উদ্যোগ ও পরিচর্যার অভাবে বাংলাদেশে তুলা উৎপদন কম। ফলে বিভিন্ন দেশে থেকে আমদানি করতে হচ্ছে তুলা। এতে নানা ধরনের ভোগান্তি ও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠানকে।
তিনি মনে করেন, দেশে তুলা শিল্পের এমন দৈন্যদশার জন্য দায়ী তুলা উন্নয়ন বোর্ড। মাঠপর্যায়ের কাজ না করেই বোর্ড কর্মকর্তারা বসে বসে সরকারের বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। দেশের কোথায় তুলা হবে? তুলা কিভাবে চাষ করতে হবে? এ বিষয়ে কৃষকদের সঙ্গে তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করতে ব্যর্থ। তুলার বাজার সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা নেই। তুলা উন্নয়ন বোর্ড বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
অপরদিকে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ফখরে আলম ইবনে তাবিব দাবি করেন, বর্তমান আমরা তুলা উৎপাদনে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছি। সরকারের সহযোগিতায় তুলা উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাঠপর্যায়ে চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে। সরকারের সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে দেশীয় তুলা শিল্প আরও এগিয়ে যাবে।
দেশের চাহিদা পূরণ এবং আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে তুলা উৎপাদনের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠা করা হয় তুলা উন্নয়ন বোর্ড। ১৯৭৬ সালে পরীক্ষামূলক তুলা উৎপাদনের মধ্যদিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। উৎপাদন বৃদ্ধি করতে তুলা নিয়ে গবেষণা, তুলা চাষ সম্প্রসারণ, বীজ উৎপাদন ও বিতরণ, প্রান্তিক কৃষকদের প্রশিক্ষণ, তুলা বাজারজাতকরণ ও কৃষকের মাঝে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে তুলা উন্নয়ন বোর্ড। এই প্রতিষ্ঠানের নিবিড় পর্যাবেক্ষণে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ মৌসুমে ৪৫ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হচ্ছে। দেশের ৩৯টি জেলার ১৩২টি উপজেলায় ৭৮ হাজার কৃষক তুলা চাষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ৮ শতাংশ সুদে দেওয়া হচ্ছে কৃষি ঋণ। ফলে প্রতিবছরের মতো এবারও ২ লাখ বেলের অধিক তুলা চাষ হবে বলে আসা করছে তুলা উন্নয়ন বোর্ড।
অথচ দেশে প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ বেল তুলা প্রয়োজন হয়। যার ৮৯ শতাংশ তুলা অস্ট্রোলিয়া, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এতে প্রতিবছর প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তুলা আমদানি করতে গিয়ে নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে দেশীয় ব্যবসায়ীরা। তবুও দেশে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কার্যত উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, দেশের তৈরি পোশাক খাতে যে পরিমাণ তুলা প্রয়োজন, তার অর্ধেক দেশে উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সঠিক উদ্যোগের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে আমদানি করতে হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের অর্থ বাহিরে চলে যাচ্ছে।
তাদের ভাষ্যমতে-বিশ্বের যেসব দেশ তুলা উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছে তাদের কৃষকদের সরকার পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার যদি তুলা উৎপাদনে সহযোগিতা না দেয়, তাহলে কোনোভাবেই দেশে তুলা উৎপাদনে সফলতা পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ দেশের কৃষকদের তুলা চাষ ও তুলা সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা নেই।
আল মদিনা ইন্ডাস্ট্রিজের প্রোফাইটার মো. গোলাম সাবের যুগান্তরকে বলেন, দেশে তুলা উৎপাদনে লোকবলের অভাব। বিজ্ঞানের অভাব। তুলা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না। মাঠপর্যায়ে অফিসার কম। তারা ঠিকঠাক মাঠ পরিদর্শনে যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় শত চেষ্টা করলেও এই ফসলে সফলতা আনা সম্ভব নয়। তাই তুলা উন্নয়নে তুলা বোর্ডকে নতুনভাবে সাজাতে হবে। দক্ষ ও অভিজ্ঞ অফিসারদের দায়িত্ব দিতে হবে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে এবং বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা যুক্ত করতে হবে। তবেই সফলতা আসবে।
বর্তমানে দেশে চার জাতের তুলা চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে-চরাঞ্চলের জন্য চর কটন, পাহাড়ের জন্য হিল কটন, সমতলের জন্য আপলাইন কটন ও বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য ড্রাউট কটন। এসব তুলা চাষের উৎকৃষ্ট সময় ১৫ আষাঢ় থেকে ৩০ শ্রাবণ (১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট) পর্যন্ত। তুলা চাষে উৎকৃষ্ট জমি দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি। পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ যেকোনো মাটিতেই তুলার চাষ করা যায়। তবে খুব বেশি বেলে বা কর্দমাক্ত জমিতে তুলা চাষ করা যায় না।
শুরুর দিকে প্রতি বিঘা জমিতে ৭ থেকে ৮ মন তুলা উৎপাদন হতো। তবে বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতোই হাইব্রিড তুলা উৎপাদনে ঝুঁকছে বাংলাদেশ। গত ১০ থেকে ১২ বছরে এই তুলা উৎপাদন করে সাফল্যে পেয়েছেন দেশীয় চাষিরা। হাইব্রিড বিজে ৩৩ শতাংশ জমিতে ২০ মন ফলন হচ্ছে।
এদিকে প্রতিষ্ঠার ৫২ বছরে এই প্রথম ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তুলা চাষে ৯ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। এই ভর্তুকি সরাসরি নগদায়ন না করে দেশের ২৬ জেলায় ১২ হাজার ৩৭৫ জন কৃষককে বিভিন্ন ধরনের সার, হাইব্রিড বীজ, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ওষুধসহ বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করার মাধ্যমে দেওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে কয়েকজন তুলাচাষি যুগান্তরকে বলেন, এভাবে প্রণোদনা দেওয়ার নামে চাষিদের প্রকারান্তরে ঠকানো হচ্ছে। প্রণোদনার নামে যেসব বীজ-কীটনাশক সরবরাহ করা হয় নিুমানের।
তুলা আঁশজাতীয় অর্থকরী ফসল। তুলা ফসল হতে আঁশ ছাড়াও তুলা বীজ হতে উপজাত হিসাবে ভোজ্যতেল ও খৈল পাওয়া যায়। দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ১৩টি জিনিং মিল তুলা বীজ হতে ভোজ্যতেল উৎপাদনের ১টি শোধনাগার রয়েছে।
জনবলের তথ্য : বর্তমান তুলা উন্নয়ন বোর্ডে পদের সংখ্যা ৮৬৪, কর্মরত রয়েছেন ৪৮৭ জন এবং শূন্য পদের সংখ্যা ৩৭৭টি। যশোর, রংপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় রয়েছে চারটি আঞ্চলিক অফিস। এছাড়া জোনাল অফিস আছে ১৩টি। এসব অফিসের অবস্থান যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ঢাকা ও ময়মনসিংহ। এছাড়া ইউনিট কার্যালয় রয়েছে ১৮৫টি। এসব অফিসের পেছনে প্রতিবছর সরকারের বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হচ্ছে।