জুলাই-আগস্টে দেশ জুড়ে ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। যে আন্দোলনে সহস্র শহীদের পাশাপাশি আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। এদের মধ্যে অনেকের চোখে গুলি লেগেছে। আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। তবে চোখে গুলিবিদ্ধ অন্তত ৩৪ জন এখনো জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বেডে কাতরাচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকেই সারা জীবনের মতো দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। আহতদের অনেকে ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় এসব ব্যক্তি। গতকাল সরজমিন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আগে শত শত রোগী আন্দোলনে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসা নিলেও বর্তমানে হাসপাতালটির ৪র্থ তলার ৫টি রুমে চিকিৎসা নিচ্ছেন মোট ৩৪ জন। মূলত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের জন্য ৪তলায় ডেডিকেটেড কেয়ার ইউনিট নামে বিশেষ ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে বিনা খরচে শুধু আন্দোলনে আহতদেরই চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। তাদের একজন সিলেটের সুজন আহমেদ। ২২ বছরের এই যুবক প্রথম থেকেই সিলেটের আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। গত ২৪শে জুলাই সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন। ডান চোখে গুলি লাগে। এরপর তার সঙ্গীরা তাকে উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পাঁচদিন হাসপাতালটিতে থাকলেও চিকিৎসা সেবায় খুশি নন তিনি। সুজন বলেন, আমি পাঁচদিন ব্যথায় কাতরালেও আমাকে কোনো চিকিৎসা দেয়া হয়নি। সেখান থেকে বলা হয়- আপনার চোখের মধ্যে গুলি ঢুকে গেছে। এখান থেকে সেটা বের করা সম্ভব নয়। আপনি ঢাকায় যান। এরপর আমি ঢাকায় চলে আসি। এখনে আসার পর ডাক্তাররা আমাকে জানান, আমার চোখের গুলি বের করা যাবে না। যদিও যায় তাও কোনোদিন চোখে দেখতে পারবো না। তখন থেকেই হাসপাতালে হাসপাতালে। একবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। আরও একবার লাগবে। কিন্তু ডান চোখে আর কোনোদিনও দেখতে পাবো না। ছেলে সুজন যখন এসব কথা বলছেন তখন তার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন মা নাজমা বেগম। নাজমা বেগম বলেন, আমাদের বাড়ি সিলেটের শিবগঞ্জে। আমার স্বামী তারিফ আহমেদ পেশায় একজন বাবুর্চী। তার আয়ে সংসার চলে না বলে বড় ছেলে সুজনকে স্থানীয় একটি প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে কাজে দিয়েছিলাম। এখন আন্দোলনে তার চোখটা চলে গেল। আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, ওর সারাটা জীবন পড়ে রয়েছে। ওর কী হবে। চোখে না দেখলে তো ওকে আর কেউ কাজেও নিবে না। আমাদের তেমন সামর্থও নেই। এখন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা না করলে ওর জীবন শেষ হয়ে যাবে। সুজনের পাশের বেডেই চিকিৎসা নিচ্ছেন চট্টগ্রামের সমজান মিয়া। এই নির্মাণ শ্রমিক বলেন, চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় একটি বহুতল ভবনে শ্রমিক হিসাবে কাজ করছিলেন তিনি। গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। আমি অবস্থা বেগতিক দেখে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পুলিশ গুলি ছোড়া শুরু করে। সেই শটগানের ছররা গুলি এসে আমার চোখসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লাগে। আমি তখনো বুঝতে পারিনি আমার চোখের মধ্যে গুলি ঢুকে গেছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে প্রথমে আমাকে তখন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর একটি স্থানীয় হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে কোনো চিকিৎসা দেয়া হয় না। এরপর ফৌজদারহাটের একটি মেডিকেলে যাই। সেখান থেকে সাধারণ চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এরপর গত ৯ই আগস্ট আমি চট্টগ্রাম মেডিকেলে যাই। সেখানে একেক জন ডাক্তার একেক বার এসে আমার চোখের ছবি দেখে চলে যায়। এর একদিন পর আমাকে জানানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেলে আমার চিকিৎসা হবে না। ঢাকায় যেতে হবে। পরে আমি ঢাকায় এসে এখানে ভর্তি হই। এখানে আসার পর আমার চোখে একবার অপারেশন হয়েছে কিন্তু এখনো গুলি বের হয়নি। ডাক্তার জানিয়েছেন, আমি কোনোদিন আর ডান চোখে দেখতে পাবো না। সমজান মিয়া বলেন, আমার ছোট ছোট তিনটে ছেলেমেয়ে। আমি এই নির্মাণ শ্রমিকের কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ জানি না। এখন চোখে না দেখলে সেই কাজ করতে পারবো না। আমি আমার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এতদিন চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়েই আমার সব শেষ। থাকা-খাওয়া সব ধারদেনা করে চালাচ্ছি। আমার বাচ্চাদের নিয়ে সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটাবো তাই নিয়ে চিন্তায় আছি।
এদিকে গত ১৯শে জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় বাম চোখে গুলিবিদ্ধ হন রিপন আহমেদ। দশমাসের সন্তান আয়াত ও স্ত্রীকে নিয়ে তিনিও দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৪ তলায়। রিপন জানান, আন্দোলন যখন তুঙ্গে সকলে ঘর থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে তখন আমিও আর বসে থাকতে পারিনি। আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দেই। সেদিন পুলিশের গুলিতে একের পর এক নিহতের খবর আসছিল। পুলিশ নির্বিচারে গুলি করছিল। আমরাও রাস্তা ছাড়িনি। এরই মধ্যে হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে আমার চোখে। চোখে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছিল। আমি রাস্তায় লুটিয়ে পড়ি। এক পর্যায়ে আমার সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। যখন জ্ঞান ফেরে আমি তখন হাসপাতালে। এরপর সেখান থেকে আমাকে এই চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেদিন প্রাণে বাঁচলেও চোখের দৃষ্টি হারিয়ে গেছে সারাজীবনের মতো। আমার এই দশ মাসের বাচ্চা ও স্ত্রীর আমি ছাড়া কেউ নেই। আমার পারিশ্রমিকেই তাদের মুখে অন্ন জুটতো। এখন তো কাজও করতে পারবো না। অন্ধ লোককে কেউ কাজেও নিবে না। আমার বাচ্চাটাকে কীভাবে বড় করে তুলবো, কীভাবে সংসারের খরচ মেটাবো কিছুই বুঝতে পারছি না। ১৯শে জুলাই একইদিনে রাজধানীর বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় চোখে গুলিবিদ্ধ হন মো. সাজ্জাদ হোসেন। সাজ্জাদ বলেন, সেদিন জুমার পর অন্যদের সঙ্গে আমি বাড্ডার আন্দোলনে যোগ দেই। পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে একের পর এক গুলি ছুড়ছিল। সেই গুলির একটি এসে লাগে আমার ডান চোখে। তারপর থেকে আমি আর এই চোখটা দিয়ে কিছুই দেখতে পারছি না।
সিলেটের গোলাপগঞ্জের সামাদ আহম্মেদও একই ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনিও একটি চোখের জ্যোতি হারিয়েছেন। গতকাল সকালে তার চোখে অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা। তাই হাসপাতালের বেডে বসে হিসাব মিলাচ্ছেন বাকি জীবনের। সামাদ বলেন, আমি একটি ওয়ার্কশপে ওয়েল্ডিং এর কাজ করতাম। গত ৪ঠা আগস্ট পুলিশের গুলিতে আমি আহত হই। এরপর ওসমানী মেডিকেলে যাই। সেখান থেকে আমাকে ঢাকায় আসতে বলা হয়। সামাদ বলেন, বছর দুয়েক বিয়ে করেছি। ছয় মাস বয়েসের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। এখন আমি এক চোখে আর কোনোদিন দেখতে পাবো না। কাজ ছাড়া আমি পরিবার নিয়ে কীভাবে বাঁচবো।