দেশ চালাতে সরকার এখন টাকার জন্য মরিয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস টাকা চেয়েছেন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের কাছে। টাকার অভাবে যখন বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তখন জানা গেল পরিবহন মাফিয়া খন্দকার এনায়েত উল্লাহই চাঁদাবাজি করে তুলেছেন প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এই টাকায় কর্ণফুলী টানেলের মতো আরেকটি টানেল বানানো যেত।
চূড়ান্ত হিসাবে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে খরচ ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। পুরো চাঁদাবাজিতে এনায়েত উল্লাহ ‘ক্যাশিয়ারের’ ভূমিকায় থাকলেও তাঁর হাত ধরেই ভাগ পেয়েছেন মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ, মালিক-শ্রমিক নেতারাও। ১৬ বছর ধরে রাজধানীসহ সারা দেশেই পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির এ নৈরাজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছেন এনায়েত উল্লাহ। পরিবহন মালিক সমিতি ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের নথিপত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
চাঁদাবাজির মাত্রা পর্যালোচনা করতে গিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের একটি ‘কেসস্টাডি’ বিশ্লেষণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ওই মহাসড়কেই প্রতিবছর পরিবহন খাতে চাঁদা তোলা হয় ৩৮ কোটি টাকা। চাঁদার ভাগ মাসিক হারে কাকে কত দেওয়া হতো তার একটি তালিকা কালের কণ্ঠ’র প্রতিবেদকদ্বয়ের হাতে এসেছে। পদাধিকার বলে চাঁদার ভাগ পেত সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী, শ্রমিক ও মালিক নেতা, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারি অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তাসহ ২১ জনের একটি চক্র।
শুধু এই মহাসড়ক থেকে খন্দকার এনায়েত উল্লাহ একাই মাসে চাঁদা পেতেন ১০ লাখ টাকা।
শুধু একটি মহাসড়কই নয়, সারা দেশে এ রকম চাঁদাবাজির মচ্ছব জারি রেখেছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। অভিযোগ এসেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্টের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খন্দকার এনায়েত উল্লাহ এই দুই সংগঠনের মহাসচিব ছিলেন। এই সময়ে পুরো দেশের পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির প্রধান নিয়ন্ত্রকই ছিলেন তিনি।
খন্দকার এনায়েত উল্লাহ কিভাবে চাঁদা আদায় করতেন তার একটি বিবরণ দিয়েছেন দুই পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা।
এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো চিঠির সূত্র ধরেও অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরেও পরিবহন খাতের দুই সংগঠনের অন্তত ২০ জন বঞ্চিত ও পদধারী নেতার সঙ্গে আলাপ করেছেন কালের কণ্ঠ’র এই প্রতিবেদকরা। তাঁদের দেওয়া তথ্য মতে, ঢাকা মহানগরী ও আন্ত জেলা পর্যায়ে ১৫ হাজার বাস ও মিনিবাস চলাচল করে। ২০০৯ সালের ১ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত এসব পরিবহন থেকে দিনে এক হাজার ২০০ টাকা করে সমিতির পক্ষ থেকে চাঁদা আদায় করা হতো। টাকার অঙ্কে দিনে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা চাঁদা উঠত। মোট চার হাজার ৪১ দিনে চাঁদা উঠেছে সাত হাজার ২৭৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
করোনা মহামারির সময় সরকারি যান চলাচল সীমিত ছিল। ফলে ২০২০ সালের জুনে একটি গাড়ির জন্য সব স্তর মিলিয়ে ৬০ টাকা চাঁদা নির্ধারণ করা হয়। ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত মোট ১৫ হাজার গাড়ি থেকে ৬০ টাকা করে দৈনিক ৯ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। সে হিসাবে মোট এক হাজার ৪২১ দিনে ১২৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা চাঁদা ওঠে।
এ ছাড়া দেশের প্রতিটি জেলা মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বাস, মিনিবাস, ট্রাক, ট্যাংকলড়ি, অটোটেম্পো হিউম্যান হলার (লেগুনা), সিএনজিচালিত অটোরিকশার চলাচলের জন্য প্রতি মাসে এনায়েত উল্লাহকে এক লাখ টাকা করে দেওয়া হতো। এই খাত থেকে দিনে ৬৪ লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন এনায়েত উল্লাহ। ফলে মোট পাঁচ হাজার ৪৬২ দিনে চাঁদা নিয়েছেন তিন হাজার ৪৯৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে গত ১৬ বছরে ১০ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা চাঁদা তুলেছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।
বর্তমান ঢাকা মালিক সমিতির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও ট্রানসিলভা পরিবহনের চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ঢাকার পরিবহন খাতকে লুটে নিয়েছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে নিজের পকেট ভরেছেন। তাঁর চাঁদাবাজির অন্যতম দোসর খোকন, তপন, মহারাজ, মাহাবুব ও সেলিম নামের ব্যক্তিরা। তাঁরা পরিবহন কম্পানিগুলোকে জিম্মি করে চাঁদা আদায় করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি নিয়ে সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশও (টিআইবি) একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। সংগঠনটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে এক হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। আর এই চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠন, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া দেশের বৃহৎ বাস কম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ মালিকই রাজনীতিবিদ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকে ওই সব দলের সমর্থনপুষ্ট। জানা যায়, চাঁদাবাজি না থাকলে যাত্রীদের ৬০ শতাংশ ভাড়া কমে যেত।
হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। এসব অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজির এসব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু কখনো এগুলো প্রমাণ করা যাবে না। কারণ আমি কোনো চাঁদাবাজি করিনি। সংগঠন যে চাঁদা নিত সেটা নিয়ম অনুযায়ী নিত। কোনো জেলা সমিতি বলতে পারবে না, আমি চাঁদাবাজি করেছি।’
প্রতি জেলা থেকে এক লাখ করে টাকা চাঁদা আসত—এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাস থেকে মাসে দিত এক হাজার আর ট্রাক থেকে দুই হাজার। তাও সেই টাকা আমাকে নয়, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিকে দেওয়া হতো। কাউন্সিলের সময় দেখা যেত বেশির ভাগই চাঁদার টাকা শোধ করেনি। উল্টো ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আয় থেকে সারা দেশে সমিতির কার্যক্রম চালানো হতো।’
এ বিষয়ে পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবহন শিল্পের সব পক্ষ মিলে চাঁদা নিলেও তা শ্রমিকের কল্যাণে ব্যয় করা হয়নি। চাঁদা যেভাবেই তোলা হোক তার সবটুকুই গেছে মালিক সংগঠনের নেতাদের পকেটে। সেখানে মহাসচিব প্রভাব খাটিয়ে সব দখলে রেখেছিলেন। শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দিতে সরকারের আইন থাকলেও তা মানা হয়নি। শ্রমিকদের ঠকিয়ে মালিকরা হাজার কোটি টাকা বানিয়েছেন।’
বর্তমান সরকারের কাছে তিনি দাবি করে বলেন, ‘মালিকদের অবৈধ চাঁদার হাত থেকে শ্রমিক ও যাত্রীদের রক্ষা করতে হবে। যদি শ্রমিকদের কল্যাণে চাঁদা তোলা হয়, সেটি শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা হোক।’
পরিবহন খাতের প্রভাবশালী এই মালিক নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহর উত্থান হয় ১৯৯১ সালে। তখন রাজধানীর মিরপুরে তিনি বাসের ব্যবসা করতেন। নিজের বাসে নিজেই শ্রমিকও ছিলেন। তারপর ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পথে এনা পরিবহন নামে বাসের চলাচল শুরু করার পর তাঁর ভাগ্য খুলে যায়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি শুরু করা এনা পরিবহন ঢাকার মহাখালী থেকে ময়মনসিংহের পথে একমাত্র পরিবহনে পরিণত হয়। অন্য কোনো পরিবহনকে এখানে তিনি দাঁড়াতে দেননি। ২০ থেকে ২৫টি বাস দিয়ে শুরু হওয়া এনায় এখন ৪০০ বাসের বহর। যদিও এখন এই পথে এনা পরিবহন খুব একটা দেখা যায় না। মহাখালী টার্মিনালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০ শতাংশের মতো এনা পরিবহনের বাস সড়কে চলছে। বাকি বাস নাম পরিবর্তন করে অন্য প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলার চেষ্টা করছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাঁর ব্যবসা বড় হতে শুরু করে। তবে ১/১১-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় দেশ ছেড়ে ভারত চলে যান তিনি। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আবারও দেশে ফিরে পরিবহন সমিতির নেতৃত্বে বসেন। সেখান থেকে শুধু সামনেই এগিয়ে গেছেন খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তিনি নৌকার টিকিট নিয়ে সংসদে পর্যন্ত যেতে চেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৫ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আশা করে দলীয় আবেদনপত্র সংগ্রহ করেন। কিন্তু তখন তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ছিলেন। তবে পরিবহন খাতে এই চাঁদাবাজিতে সভাপতির দায় কতটুকু এমন প্রশ্নও উঠেছে। কিন্তু তিনি কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/10/02/1430938