খেলাপি ঋণ নবায়নে আর কোনো ছাড় দেয়া হবে না। এমনকি মেয়াদি ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রেও কোনো প্রকার শিথিলতা দেখানো হবে না। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ীই ঋণ পুনঃতফসিল করতে হবে। মেয়াদি ঋণ খেলাপির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে যে ৩ মাস সময় এগিয়ে আনা হয়েছে তাই বলবৎ থাকবে। আর এ কারণে এস আলমসহ বড় বড় রাঘব বোয়ালদের ঋণ গতকাল থেকে খেলাপি হওয়া শুরু হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকসহ ৮ ব্যাংক থেকে সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম নামে বেনামে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিলেন। এত দিন ব্যাংকগুলো তার দখলে থাকায় নানা উপায়ে পরিশোধ না করে নিয়মিত দেখানো হতো। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে। এরপর থেকেই ওইসব ঋণ আর অনিয়মের মাধ্যমে নবায়ন হচ্ছে না। ইতোমধ্যেই ওইসব ঋণ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মাফিয়াদের নামে বেনামে থাকা ঋণ আর কোনোক্রমেই নিয়মিত করা হবে না। একমাত্র সমাধান হবে জনগণের আমানতের অর্থ ফেরত দেয়া। অন্যথায় এসব ঋণ খেলাপি করা হবে। আর খেলাপি হলে ওইসব প্রতিষ্ঠান আর কোনো এলসি খুলতে পারবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে এস আলমসহ বিভিন্ন গ্রুপ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিলের জন্য তদবির করছে। নানাভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে নমনীয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল পর্যন্ত এস আলমের এ আব্দারে সাড়া দেয়নি। এর ফলে আজ থেকেই এসব ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দেড় দশকের অপশাসনের সময় নানাভাবে ঋণ খেলাপিদের ছাড় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আর কোনো ছাড় দেবে না। ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রেও আর কোনো শিথিলতা দেখানো হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, গত বছর শেষে ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ৫২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করে। পরের বছর ২০২০ সালে পুনঃতফসিল কম হয়। ওই বছর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে করা হয় ২৬ হাজার ৮১০ কোটি, ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি এবং ২০২৩ সালে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে পুনঃতফসিল ঋণ বেড়েছে ৪৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
গত বছর পুনঃতফসিল ঋণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড় নীতি ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দায়ী করা হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে প্রার্থী হতে গত বছরের শেষ দিকে অনেক প্রার্থীই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত হন। এ ছাড়া বছর শেষে নিজেদের আর্থিক হিসাব ভালো দেখাতেও শেষ প্রান্তিকে অনেক খেলাপি গ্রাহকের ঋণ উদার হস্তে নবায়ন করে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১২ সালের সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ঋণের কিস্তি পর পর ৩ মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত পরিশোধ করা না হলে ওই ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে। ৬ মাস থেকে ৯ মাসের মধ্যে পরিশোধ না করলে সন্দেহজনক খেলাপি ঋণ ও ৯ মাস পার হলে তা মন্দমানের খেলাপি ঋণ হবে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ২০১৯ সালে ব্যবসায়ীদের দাবির কারণে মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তখন বলা হয়, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার কোনো পরিবর্তন হবে না। তবে মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৬ মাস পর্যন্ত খেলাপি করা যাবে না। এ হিসেবে কোনো ব্যবসায়ী মেয়াদি ঋণ নিয়ে ৯ মাসের সাথে আরো ৬ মাস অর্থাৎ ১৫ মাস পরিশোধ না করলেও ওই ঋণকে খেলাপি করা হতো না। এর ফলে বিপুল অঙ্কের ঋণ পরিশোধ না করা সত্ত্বেও খেলাপি ঋণের বাইরে চলে যায়। অর্থাৎ বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাত থেকে আড়াল হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে খেলাপি হওয়ার নীতিমালা শিথিলতা থেকে কিছুটা কঠোর করা হয়। চলতি বছরের এপ্রিলে দেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সার্কুলারে বলা হয়, মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে মেয়াদ উত্তীর্ণের যে ৬ মাস সময় দেয়া হয়েছিল তা তিন মাস এগিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ মেয়াদ উত্তীর্ণের ৩ মাস পরই মেয়াদি ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে। এ সার্কুলার ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে। আর ২০২৫ সালের মার্চ থেকে বাকি তিন মাস মেয়াদ উত্তীর্ণের সময়ও বাতিল করা হবে। অর্থাৎ আজ এক অক্টোবর থেকে মেয়াদি ঋণ খেলাপি হতে সময় কমিয়ে ১২ মাস করা হয়েছে। আগামী বছরের মার্চ থেকে তা মেয়াদ উত্তীর্ণের মেয়াদ শূন্য করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০১২ সালের নির্দেশনাই আবার বলবৎ হবে।
এ দিকে ব্যবসায়ীরা সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে বৈঠক করে এ নীতিমালা আবারো শিথিল করতে অনুরোধ করে। গতকাল ৩০ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা কার্যকর হওয়ার শেষ দিন হওয়ায় অনেকেই এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। রাঘববোয়াল ব্যবসায়ীরা ধরেই নিয়েছিল গত ১৫ বছরে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার মাধ্যমে যেভাবে নীতিমালা শিথিল করা হতো, এখনও তা করা যাবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গতকাল এ বিষয়ে কোনো নীতিমালাই শিথিল করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মনোভাবের কারণেই স্বৈরাচারের দোসরা অনেকটা হতাশই হয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ১৫ বছর যেভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে ম্যানেজ করা গেছে, এখন থেকে আর তা করা যাবে না। যদিও এস আলম, আকিজ উদ্দিনের সুবিধাভোগী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা এখনো তৎপর রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ কর্মকর্তা দেশপ্রেমিক হওয়ায় দোসররা তেমন কোনো সুবিধা নিতে পারবে না বলে তারা মনে করছেন।