সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি, ঋণের মান কমে যাওয়া, প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। এ ধরনের সম্পদ বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলো একদিকে দুর্বল হয়েছে, অন্যদিকে আর্থিক ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর সম্পদ থেকে আয় কমে গেছে। যে কারণে ঋণ বা বিনিয়োগ থেকে আয় হয়েছে নিম্নমুখী। অর্থাৎ ব্যাংকের আয়ের সিংহভাগই আসে ঋণের সুদ বা মুনাফা থেকে।
গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে দেশের সার্বিক অর্থনীতিসহ আর্থিক খাতের সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়া ব্যাংকগুলোর সম্পদে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতি, জলবায়ু ঝুঁকির বিষয়গুলোও রয়েছে। এ বিষয়গুলো আলোচ্য প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়নি।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে দেশের ব্যাংকগুলোতে ঋণঝুঁকি ও পরিচালনগত ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। তবে বাজার ঝুঁকি কিছুটা কমেছে। ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বা সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। যা গত বছরের তুলনায় ৬ দশমিক ০২ শতাংশ বেশি। ব্যাংকের পরিচালনগত ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। ২০২২ সালের তুলনায় যা ৯ শতাংশ বেশি। ওই বছরে এ সম্পদ ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা।
বাজারভিত্তিক ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ সামান্য কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। যা ২০২২ সালের তুলনায় ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ কম। এসব মিলে ব্যাংক খাতে মোট ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকায়। এর মধ্যে ঋণঝুঁকি ৮৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাজারঝুঁকি ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। পরিচালনগত ঝুঁকি ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। সম্পদ বাড়ার চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়েছে বেশি মাত্রায়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের মান কমে যাওয়া। ফলে সেগুলোর একটি অংশ খেলাপি হয়ে পড়ছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার তুলনায় ব্যাংকগুলোর নিট আয় সেভাবে বাড়েনি। ফলে নিট আয় থেকে প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতি মেটাতে চাহিদা অনুযায়ী পুঁজির জোগান দিতে পারছে না।
ব্যাংকগুলোর সুদের হারের বিপরীতে ঝুঁকির মাত্রা কমেছে। ’২২ সালে এ খাতে ঝুঁকি ছিল দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০২৩ সালে এই ঝুঁকির মাত্রা কমে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৬ শতাংশে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ঝুঁকিও কিছুটা কমেছে। কারণ ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করেছে।
ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানিতে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আস্থার অভাব। অনেক ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানি অন্য ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানিতে সঞ্চয়কারীদের আমানতের অর্থ বিনিয়োগ করে সময়মতো ফেরত পাচ্ছে না। ওইসব প্রতিষ্ঠান আর্থিক দুর্বলতার কারণে টাকা ফেরত দিতে পারছে না। বিষয়টি এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যন্ত নালিশ গেছে। যে কারণে ২০২৩ সালে এ ধরনের বিনিয়োগের মাত্রা কমে গেছে। ২০২২ সালে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর অন্য ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানিতে বিনিয়োগ বা ঋণ দেওয়া ছিল ৭৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালে তা কমে ৭৬ হাজার ৭৭০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়ছে। ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত তারল্য সাধারণত মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগ করে। বিশেষ করে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোই মুদ্রাবাজারের প্রধান গ্রাহক। কিন্তু এ বাজারে বিনিয়োগ করা অর্থ যথাসময়ে ফেরত না আসায় এ খাতে বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সম্পদের মান খারাপ হওয়ায় ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো বহুমুখী সংকটে পড়েছে। সম্পদের ওপর থেকে আয় কমে গেছে। একই সঙ্গে কমেছে সম্পদের মান। ঝুঁকির তীব্রতা ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে এসে কিছুটা কমেছে। ব্যাংকগুলোর ঋণের বা বড় গ্রাহক করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বড় অংশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। একই সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণের হারও বেশি। মোট খেলাপির ৫৪ দশমিক ৮২ শতাংশই রয়েছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে ঝুঁকি নিরূপণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখেছে মাঝারি ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা রয়েছে ব্যাংকগুলোর। বড় ধরনের ঝুঁকি এলে সেগুলো মোকাবিলার সক্ষমতা নেই। মূলত মূলধন পর্যাপ্ততা কম, প্রভিশন ঘাটতি বেশি, ঝুঁকি মোকাবিলায় রিজার্ভ তহবিলে সংরক্ষিত অর্থের পরিমাণ কম থাকার কারণেই এমনটি হয়েছে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকগুলোতে সম্পদের মান কমে যাওয়ায় বেশির ভাগ ব্যাংকই তহবিলের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংরক্ষণমূলক নীতি গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে ভালো ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তহবিলের অর্থ মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগ করছে না। কারণ এতে ঝুঁকি আছে। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ধার দিলে সে অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে।
সূত্র জানায়, মুদ্রাবাজার ব্যাংকগুলো দিয়েই পরিচালিত হয়। তারাই সে খাতে বড় ক্রেতা-বিক্রেতা। ব্যাংক ব্যবসার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে মুদ্রাবাজার। আস্থার সংকটে সেই মুদ্রাবাজার এখন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এতে দুর্বল ব্যাংকের পাশাপাশি সবল ব্যাংকগুলোও সমস্যায় পড়ছে।