বর্তমান অবস্থায় অর্থনীতির তিনটি অবস্থার দিকে আমরা নজর দিতে পারি। যেমন সামষ্টিক অর্থনীতি, মধ্যম অর্থনীতি এবং ব্যক্তি অর্থনীতি। শেষেরটির অবস্থা বাজারে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ দেখলেই বুঝা যায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আর্থিক খাত খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। টাকার মান কমে গেছে, ডলারসংকট তৈরি হওয়াতে আমদানিও কমিয়ে দিতে হয়েছে। এছাড়াও রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়তে থাকায় আমাদের প্রবৃদ্ধি এখন প্রশ্নের সম্মুখীন।
শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব বিশাল আকার ধারণ মধ্যম অর্থনীতির পর্যায়কে ইঙ্গিত করে। ২০১৬ ও ২০২৩ সালের সময়কালে শিল্প ও সেবা খাতে কর্মসংস্থান কমে গেছে। বেড়েছে কৃষি খাতে। বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। প্রবৃদ্ধি বাড়ার সাথে সাথে বেকারত্বও বাড়ছে। এই অবস্থা অর্থনীতিতে যে ঝুঁকি তৈরি করেছে তাকে অর্থনীতিবিদদেরকে নতুন করে বর্ণনা করতে হবে।
কোভিডের সময় থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি কমতে শুরু করে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে তেলের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ডলার-সংকটের কারণে অর্থনীতি আরেক দফা ধাক্কা খায়। এই বাস্তবতায় ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর অর্থনীতি যখন স্থিতিশীল হতে শুরু করে, তখন গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন হলে দেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে।
বিগত সরকারের পতনের পর কলকারখানা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। এই মুহূর্তে সরকারের মূল লক্ষ্য হলো, সাধারণ নির্বাচনের পূর্বেই অর্থনীতি পুনরায় পুরোপুরি সচল করা। সরকার ভাল করে জানে যে তার হাতে কী পরিমাণ অর্থ আছে, কী পরিমাণ চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে তাকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে।
১৫ বছরের লুটপাট, দুঃশাসন ও সন্ত্রাসের রাজত্বের সমস্ত অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। আসলে নজিরবিহীন অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে ব্যাংক খাত পুরোপুরি ধসিয়ে দেয়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি এবং পুঁজিবাজারে উপর্যুপরি কারসাজির মাধ্যমে যেভাবে অর্থ লোপাট করা হয়েছে, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে অর্থনীতির ভিত ধ্বংস করা, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বন্ধ রেখে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে গ্যাস আমদানি এবং বিদেশী কোম্পানির সাথে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তিতে দেশের স্বার্থ যেভাবে বিকিয়ে দেয়া হয়েছে, তার পরিণতিতে মেরুদ- ভেঙে পড়েছে অর্থনীতির। তলানিতে এসে ঠেকেছে অর্থনৈতিক কর্মকা-। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে শিল্পকারখানায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। বন্ধ হয়ে যায় অসংখ্য কলকারখানা। বেকার হয়ে পড়েছে বন্ধ কারখানার ও দুস্থ হয়ে পড়া শিল্পকারখানা থেকে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকরা। এমতাবস্থায় এই মুহূর্তে ইউনূস সরকারের জরুরি কাজগুলি মধ্যে অর্থনীতি পুনরায় পুরোপুরি সচল এবং আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে চার ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। এগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক খাতের ঝুঁকি। এবং এই চ্যালেঞ্জগুলির সাথে সম্পৃক্ত অর্থনীতির তিনটি ঝুঁকির দিকেও নজর দিতে হবে। প্রথম ঝুঁকি হলো, জিনিসপত্রের বাড়তি দামের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত থাকা। দ্বিতীয়ত, মুদ্রা বিনিময় হার সংস্কার বিলম্ব হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি আমদানি নিয়ন্ত্রণকে দীর্ঘস্থায়ী করা এবং তৃতীয় ঝুঁকি হলো সমন্বিত সংস্কার কর্মসূচি না নেওয়ায় তা আর্থিক খাতের চলমান ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেওয়া।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর উপায় সম্পর্কে সরকার তিনটি পন্থা অবলম্বন করতে পারে।
এক. উচ্চ মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অনেক নি¤œ ও মধ্য আয়ের পরিবাররা চাপের মুখে রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকও নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। দেশটির নীতি সুদহার এখন বিগত বছরগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও এই পরিস্থিতিতে ঋণের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে সঞ্চয়কারীদের সুবিধা হওয়াতে ব্যাংকিং সেক্টরে আমানত বাড়বে।
দুই. কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিন্তা করতে হবে যেন তাদের নীতিটা বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটানা ১০-১২ বছর কোনো পরিবর্তন করে নাই। যদিও প্রতিবেশী ভারত তাদের রুপীর অবমূল্যায়ন করেছিল। এমতাবস্থায়ও এটাকে বাজারভিত্তিক করার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন না আনায় একটা সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীভুক্ত ব্যবসায়ীদেরকে সুবিধা দেবার জন্য বিনিময় হার বা নীতি সুদহার পরিবর্তন করে নাই। তাই এখন নীতি সুদহার বাড়িয়েও তার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের সরবরাহ-শৃঙ্খলা ও বাজার কাঠামো ভেঙে যাওয়াতে নীতি সুদহার বাড়িয়েও এখন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের নিয়ম কাজ করছে না।
পরবর্তীতে আবার ইচ্ছেমতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ধার দেওয়ার কারণেও বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে মুদ্রাস্ফীতিতে। অভিনব কায়দায় টাকা বিদেশে পাচারের কারণে এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড পরিমাণ মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ ও ব্যাংকের অনুমোদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিরোধ করতে পারেনি। এগুলি হচ্ছে আর্থিক খাতের রাজনৈতিককরণের ফলাফল।
তিন. খেলাপি ঋণ আসলে কত, তা বের করা জরুরি। ব্যাংক থেকে একক ব্যবসায়ী কত ঋণ পাবেন, পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে কতজন থাকবেনÑ এগুলোর মূল্যায়নও দরকার। আরও দরকার খেলাপি গ্রাহকদের খেলাপি তালিকা থেকে বের হওয়ার নীতি এবং অবলোপন নীতি প্রণয়ন করা।
একটি ব্যক্তি বা গ্রুপের হাতে ৭টি ব্যাংকের মালিকানা রাখাতে দেয়ার অর্থই হচ্ছে আর্থিক খাত কুক্ষিগত করার সুযোগ দেয়া। স্বল্প মেয়াদে আমানত সংগ্রহ করে ব্যাংকগুলো দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ তুলে দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের হাতে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ও সুশাসনের সমস্যা প্রকট। প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ব্যাংক ও পোশাক খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। একদিকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অন্যদিকে শাসনব্যবস্থায় নীতি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। আর্থিক রাজনীতির এই কুফলগুলো নিয়ন্ত্রণের বিধিবিধান সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে অর্জন করতে। এ ক্ষেত্রে সুশাসনের প্রক্রিয়া এখনই শুরু করতে হবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তৈরি পোশাকের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। তবে অনতিবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে এই খাতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে না।
মূল্যস্ফীতি
অগ্রাধিকার তালিকাগুলোর মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হলো মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। দেড় বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। বলা যায়, দুই বছর ধরে মানুষের ক্ষোভের মূল কারণ হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের কষ্ট বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের ব্যয়ের চাপ বেড়েছে। ফলে কমছে পণ্যের চাহিদাও। তার প্রভাবও পড়ছে ব্যবসায়, সঞ্চয়ে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য আমদানি দ্রব্যসমূহের দাম অতিশয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি যথাযথ পলিসি নির্ণয় করে তা মোকাবেলা করতে পারেনি।
নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্ত হয়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে ধীরে ধীরে স্থবির করে তুলছে। সামষ্টিক অর্থনীতির সব সূচক যেমন নেতিবাচক ধারায় চলছে, তেমনই খাতভিত্তিক ব্যবসার গতি কমছে। কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন, বিপণন, চাহিদা, রপ্তানিÑ সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ডলার সংকটে আমদানি কম হওয়াতে রপ্তানিতে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। স্থানীয় বাজারে সরবরাহ কমায় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যায়।
মূল্যস্ফীতি কমাতে ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হলে সরকারি ব্যয়ও কমাতে হবে। বিশ্বের অনেক জায়গায় এই সংকটে পড়া দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে হয়নি। কেন হয়নি? তার যে উত্তর সহজ। শুধু মনবাসনা পোষণ করলেই হবে না, এখানে কিছু কাজও করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। এখানে দেখা যাচ্ছে, গোষ্ঠীস্বার্থ ও ক্ষমতাসীনদের নীতি তৈরির বলয়গুলো এক কাতারে দাঁড়িয়েছে।
পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা
তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যনিরাপত্তা হতে হবে এক নম্বর বিষয়। খোলাবাজারে সাশ্রয়ী দামে যে নিত্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছিল, তা বজায় রাখতে হবে। আর নিশ্চিত করতে হবে মাথাপিছু খাদ্যনিরাপত্তা। খাদ্য উৎপাদনের তথ্য এত দিন বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা হয়েছে। এগুলো ঠিক করতে হবে। যেকোনোভাবে ঠিক রাখতে হবে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা।
সরকারকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে হবে। এবং ঘাটতি পূরণে সরকার বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভর করবে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সফল অর্থনীতির প্রাণ; সে জন্য আমাদের বেসরকারি বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে হবে। আবশ্যিক পণ্যের আমদানি ব্যতীত অন্যান্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাধ্যমে জনগণের চাহিদা মিটাতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। সংকট যে কিছুটা কেটেছে, তা সত্যি। কিন্তু সেটি ঘটানো হয়েছে কিছুটা আত্মঘাতী পথে আমদানি কমিয়ে। বিশেষত মূলধনি সামগ্রীর আমদানির গলা টিপে ধরে অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা কমানো হয়েছে। এটা ভবিষ্যত কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করার সামিল।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অন্যতম মূল কারণ তরুণদের বেকারত্ব
শিক্ষিত তরুণ সমাজকে বলা হয় দেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দুর্নীতির করাল গ্রাসে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ক্রমেই হয়ে উঠছে অনিশ্চিত। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বয়স ৩০-এর নিচে। প্রতিবছর কর্মবাজারে প্রবেশ করা বিপুলসংখ্যক তরুণদেরকে এত দিন জনসংখ্যাগত সুবিধা হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান না হলে আমরা জনসংখ্যার বর্ধনগত সুবিধাতো পাবই না, বরং তা বোঝাতেও রূপান্তর হতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বেকারত্বের হার বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের বেকারত্বের হার ছিল ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও কর্মসংস্থান সেভাবে হয়নি। এটা হলো কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। ফলে গত দুই দশকে এই দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঠিকই; কিন্তু বৈষম্যও বেড়েছে অনেক বেশি।
এছাড়াও কাজ না পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে চলে যাওয়াতে দেশ মেধাশূন্য হচ্ছে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৪৯ হাজার শিক্ষার্থী ৫৭টি দেশে গমন করেন। ২০২২ সালে ১১ হাজার শিক্ষার্থী শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই পাড়ি জমিয়েছেন। ইউনেসকোর তথ্য বলছে, ৭০ থেকে ৯০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী প্রতিবছর উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি জমায়। সব কিছুর প্রভাবে এখন শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, বরং সামাজিকভাবেও বৈষম্যমূলক সমাজে পরিণত হচছে।
আল-জাজিরা কর্মসংস্থানের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছে, বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশ কোনো কাজে, প্রশিক্ষণে বা শিক্ষায় নেই। ফলে গত দুই দশকে এই দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঠিকই; কিন্তু বৈষম্যও বেড়েছে অনেক বেশি। গত ১৫ বছরের এই বাস্তবতায় উপান্তর না দেখে দেশের তরুণদের দৃষ্টি দেশের অপরিবর্তনীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণকে কারণ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করছিল। এবং পরবর্তীতে এই আন্দোলন বিস্ফোরিত হয়ে তা তরুণ-জনতার এই অভ্যুত্থানের সূত্রপাত করে।
ব্যাপক দুর্নীতির কারণে জমি ও সম্পদের অসম বণ্টন হওয়াতে দরিদ্ররা আরো দরিদ্র হচ্ছে। দেশের ধনী ব্যবসায়ীরা সংসদে নির্বাচিত হচ্ছেই নিজেদের পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে সম্পদ অবৈধভাবে অর্জন করা। এছাড়া এসআরও-এর অপব্যবহারের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে অবৈধ মুনাফা করা। আন্তরিকতার অভাবে প্রয়োজনীয় সামাজিক সুরক্ষা নীতির সুবিধা দরিদ্ররা পাচ্ছে না। দুর্নীতির কারণে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টন কার্যত: ব্যর্থ হচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সামাজিক সংহতি ও বিশ্বাসকে ক্ষুণœ করে, অসন্তোষ ও সহিংসতাকে উসকে দেয়, দারিদ্র্য হ্রাস ও মানব উন্নয়নে বাধা দেয়, অর্থনৈতিক দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে এবং পরিবেশগত ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলে।
তাই বিদ্যমান বাস্তবতায় মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সবচেয়ে বড় কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। তা না হলে বঞ্চনা ও প্রতারিত হওয়ার বোধ তরুণদের বুকের মধ্যে আগের মতোই জ্বলতে থাকবে এবং আবার বিস্ফোরিত হবার পথ খুঁজবে।
শিক্ষিত তরুণদের মেধা ও শ্রমশক্তি যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে দেশের অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে। সে জন্য বেকারত্বের ভয়াবহতা দূরীকরণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও সৃষ্টি করতে হবে। তাই স্বনির্ভর উন্নয়ন কৌশল অবলম্বন এবং সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে অজ্ঞতা দূর করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারিগরি শিক্ষা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উচ্চশিক্ষায় বাস্তবমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। দেশে বিশেষ ধরনের মৌসুমি কর্মসূচির বাস্তবায়ন করতে হবে। ছোট এবং মাঝারি ধরনের (এসএমই) শিল্প পুনরুদ্ধার করতে হবে যা আমাদের অর্থনীতির প্রাণ যার মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সম্ভব হবে।