এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু জ্বরের এবারও আশঙ্কাজনক রূপ নিচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের সর্বোচ্চ এক হাজার ২২১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময় নতুন করে আরও আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এটিও এ বছরে সর্বোচ্চ। একদিনে মৃতদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা। এছাড়া ঢাকা উত্তর, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে একজন করে মারা গেছেন। ফলে চলতি বছরে মশাবাহিত রোগটিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৮ জনে।
দেশে হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরো আটজনের মৃত্যু হয়েছে। যা চলতি বছর একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। একইসঙ্গে এসময়ে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ১২২১ জন, যা চলতি বছর একদিনে সর্বোচ্চ। রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৭৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮৩ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ২৬৭, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২০৬, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২২৮, খুলনা বিভাগে ১৩৪ জন রয়েছেন। এছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৫৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৮ জন এবং রংপুর বিভাগে ২৮ নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এদিকে, গত এক দিনে সারাদেশে ১০৯০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ২৬ হাজার ৩৩১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ২৯ হাজার ৭৮৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১৫৮ জনের। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন।
এর আগে, গত ২২ সেপ্টেম্বর ৯২৬ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আর শনিবার তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে সাতজনের মৃত্যু হয়। রোববারের আগে যা ছিল চলতি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মির্জা মো. জিয়াউল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু নিয়েই আমাদের বসবাস করতে হবে। তবে আমাদের টার্গেট হবে ডেঙ্গু মিনিমাইজ করা। ডেঙ্গু ট্রিটমেন্টে প্লাটিলেট গুরুত্বপূর্ণ নয়। ডেঙ্গু হলে বা কোনো জ্বর হলে টেস্ট করবোই।
ডেঙ্গু এমন একটি রোগ যা ডায়নামিক। অর্থাৎ সময়ে সময়ে লক্ষণ পাল্টায়। যেকোনো সময়ে যেকোনো প্রকৃতি ধারণ করে। বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীই ভর্তি করতে হয় না। কাউন্সেলিং করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেই। ৫ থেকে ১০ শতাংশ হচ্ছে সিভিয়ার ডেঙ্গু রোগী।
প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গেল বছর দেশে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন।
আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন তিন লাখ ১৮ হাজার ৭৪৯ জন। গত বছর এক হাজার ৭০৫ জন মশাবাহিত এই রোগে মারা গেছেন, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু।
এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা যান।
জ্বর এলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার তাগিদ
‘জটিল অবস্থা হলে রোগীকে আমরা আইসিইউতে পাঠাই। পর্যাপ্ত স্যালাইন লাগতে পারে, অনেক সময় তাদের রোগীদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা থাকে না, সেক্ষেত্রে আমরা একদিনের বেতন ডোনেট করে সেই ফান্ড থেকে টাকা দেই। মিডিয়ার কাছে অনুরোধ, যত্রতত্র ওয়ার্ডে গিয়ে ছবি না তুলে আমাদের কাছে আসবেন। আমাদের এখানে অন্তত ১০০ চিকিৎসক ফ্রি সার্ভিস দেন’, যোগ করেন তিনি।
শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সী এক হাজার ৭৮৪ শিশু, ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী এক হাজার ৭৮৪ এবং ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী এক হাজার ৬৬৩ শিশু ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সী ৭ জন, ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী ১১ জন এবং ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী ৩ জন শিশু মৃত্যুবরণ করেছে। যার সিংহভাগই সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।
এদিকে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির ফলে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষায়িত বেড চালু করা হয়েছে শিশু হাসপাতারে। ১৬টি বেড দিয়ে আমরা শুরু করে প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হতে পারে জানানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানায়, ডিজিটাল ড্যাসবোর্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব তথ্য এই ড্যাসবোর্ডে থাকবে। প্রতি শনিবার ১২টার পর মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুর ওপর ব্রিফ থাকবে।