জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চলমান অধিবেশনের সাইড লাইনে ড. ইউনূসের সাথে নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনে ড. ইউনূস ছোট হননি। বরং ছোট হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। গত ২৩ সেপ্টেম্বর ড. ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক গেছেন। সেই দিনই সাধারণ পরিষদের অধিবেশন থেকে বেরিয়ে ড. ইউনূসের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন। এভাবে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের অন্য কোনো দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে বৈঠক করা পৃথিবীর বিগত ৩০ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করেন। নরেন্দ্র মোদি বৈঠক করলেন না, তাতে ড. ইউনূসের বা বাংলাদেশের কী এসে যায়? আমরা তো বাইডেনের সাথে বৈঠক দেখলাম। এরমধ্যে একইভাবে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল এ্যান্তনিও গুতেরেস প্রফেসর ইউনূসের সাথে দেখা করেছেন। দেখা করেছেন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ প্রধান। বিশ^ব্যাংক প্রধান এই বৈঠকে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য সাড়ে ৩ বিলিয়ন অর্থাৎ ৩৫০ কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আরও অবাক ব্যাপার এবং বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ হলো এই যে, শুধু আমেরিকা নয়, আরেক অর্থনৈতিক পরাশক্তি গণচীনও মুক্তহস্তে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে। নিজেদের উদ্যোগে চীন থেকে ১০ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ মেডিক্যাল টিম ঢাকায় এসেছেন। তারা ঢাকায় গত বিপ্লবে গুরুতর আহত ছাত্র-জনতার চিকিৎসা করবেন। তারা চীন থেকেই এ সম্পর্কিত মেডিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে এসেছেন। আহতদের চিকিৎসা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে তাদেরকে অনুরোধ করা হয়েছে যে, যদি সম্ভব হয় তাহলে ঐ বিশেষজ্ঞ টিম যেন ঢাকার বাইরে মফস্বলে যারা আহত হয়ে কাতরাচ্ছেন তাদেরকেও চিকিৎসা দেন। মেডিক্যাল টিম এই অনুরোধেও রাজি হয়েছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
শুধুমাত্র চিকিৎসা সেবা নয়, চীন বাংলাদেশের এনার্জি বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়নের জন্য বিশাল অবদান রাখতে রাজি হয়েছে। সকলেই জানেন যে গ্যাস, জ্বালানি, কয়লা ইত্যাদির অভাবে বাংলাদেশ প্রায়শই বিদ্যুৎ সংকট বা বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ভোগে। বাংলাদেশে কর্মরত চীনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে তারা প্রয়োজন হলে বাংলাদেশে সোলার প্ল্যান্ট বা সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসাতে পারে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইড লাইনে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েং ফি ড. ইউনূসের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। ঐ বৈঠকে ড. ইউনূস জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে চীনের সাহায্য চান। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোনোরূপ চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রস্তাবে সম্মত হন। শুধু তাই নয়, তারা প্রথমে তাদের দেশে স্থাপিত কয়েকটি সোলার প্ল্যান্ট বাংলাদেশে রি-লোকেট করা, অর্থাৎ সেই কেন্দ্রগুলো চীন থেকে বাংলাদেশে স্থানান্তর করে এখানে স্থাপন করতে রাজি হন। সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের বিশাল চাহিদা লক্ষ্য করে চীন বাংলাদেশে নতুন করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সোলার প্ল্যান্ট স্থাপন করবে। বিশেষজ্ঞ মহল এ ব্যাপারে অত্যন্ত উল্লসিত। তারা মনে করেন যে যদি লার্জ স্কেলে চীন বাংলাদেশে সোলার প্ল্যান্ট বা সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এগিয়ে আসে তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যাবে এবং লোড শেডিংয়ের ধকল পোহাতে হবে না।
এই লেখাটি লিখছি ২৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার। এখনও ইউনূসের আমেরিকা সফর শেষ হয়নি। ইতোমধ্যেই তার সাথে কথা বলার জন্য এবং বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য বিশ্বের বড় বড় ডিগনিটারিজ (Dignitaries) একের পর এক তার কাছে আসছেন। দেশ এবং বিদেশ থেকে পাওয়া প্রতিক্রিয়া হলো এই যে ড. ইউনূসের এই সফর জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানকে উপলক্ষ করে হলেও এটি দ্বিপাক্ষিকভাবে রীতিমত ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে। আগামীতে যতই দিন গড়াবে ততই এই সাফল্যের আলামত ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে।
॥দুই॥
এবার দেশীয় রাজনীতিতে আসছি। এক শ্রেণীর পত্রপত্রিকা, যাদেরকে মেইন স্ট্রিম মিডিয়া বলা হয়, সেসব মিডিয়াতে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা চলছে। আমরা পত্রিকাগুলোর নাম উল্লেখ করলাম না। ঐসব রিপোর্টে অনেক কিছুই বলা হয়েছে। আমরা তাদের বক্তব্য সম্পর্কেও এই মুহূর্তে কিছু বলবো না। এর কারণ হলো এই যে এই দেশ গত সাড়ে ১৫ বছরের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসনের ভয়াবহ নিগড় থেকে অনেক রক্ত ঝরিয়ে সবেমাত্র বেরিয়ে এসেছে। ইউনূস সরকারের বয়স এখন ১ মাস ২১ দিন। অর্থাৎ দুই মাসও হয়নি। অন্যদিকে জনগণের প্রত্যাশা সীমাহীন। গত সাড়ে ১৫ বছরে জনগণ শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের হাতে যেভাবে নিপীড়িত এবং পিষ্ট হয়েছেন, মনে হয় তারা দেড় মাসেই সেগুলোর প্রতিকার চান। সকলেই জানেন যে সাড়ে ১৫ বছরে জমিয়ে থাকা আস্তাবলের (অঁমবধহ ংঃধনষব) আবর্জনা দেড় মাসে দূর করা একটি অসম্ভব ব্যাপার। এজন্য সময় দরকার।
একদিকে সংস্কারের দাবি, অন্যদিকে দ্রুত নির্বাচনের দাবি। এই দুটিকে একটি পয়েন্টে মিলিত করা অসাধারণ রাজনৈতিক দক্ষতার দাবি রাখে। সরকারকে সকলেই সময় দেয়ার পক্ষপাতি। কিন্তু এই সময়টির দৈর্ঘ্য কত হবে সেটি নিয়ে মতানৈক্য দেখা যায়। সব শেষে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান একটি টাইম ফ্রেম দিয়েছেন। সেটি হলো ১৮ মাস বা দেড় বছর। অর্থাৎ এই দেড় বছরের মধ্যে সরকারকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা উচিৎ। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়। তারা বলে যে সংবিধান বা নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নির্বাচিত পার্লামেন্ট করবে। পক্ষান্তরে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান হলো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো হয়ে যাক। তারপর ইলেকশন। যদিও এগুলো সময় সাপেক্ষ। তাই বলে জামায়াত সরকারকে অতি দীর্ঘ সময় দিতে চায় না।
এ ব্যাপারে আমাদের মতামত খুব পরিষ্কার। রাজনীতিতে নিরন্তর পরিবর্তন ঘটে। এখন থেকে দেড় বা দুই বছর পরে কি ঘটবে সেটি এই মুহূর্তে বলা সম্ভবও নয়, উচিতও নয়। তাই যখন নির্বাচন দরজায় করাঘাত করবে তখন জামায়াত তার ইলেকশন স্ট্র্যাটেজি ঠিক করবে। জামায়াত নির্বাচনমুখী দল। তাই বলে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় যেতে হবে, সেটি জামায়াতের আদর্শ নয়। একটি আদর্শবাদী দল হিসেবে সেই আদর্শ বাস্তবায়নের কাজে যত সময় লাগুক, জামায়াত দিতে প্রস্তুত। এই আদর্শ নিষ্ঠতাই জামায়াতকে বর্তমান পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। শত জুলুম নির্যাতন এবং শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ফাঁসি জামায়াতের আদর্শিক অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারেনি। ১৫ বছরের রক্ত হিম করা নির্যাতনের পরেও জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তি ও জনপ্রিয়তা দিনের পর দিন বৃদ্ধিই পেয়েছে।
॥তিন॥
এবার ছাত্রশিবির সম্পর্কে দুটি কথা। জামায়াত তো তাও এই ১৫ বছরে মাঝে মধ্যে দুই চারটি বিবৃতি দিয়েছে। কয়েকটি ঘরোয়া সমাবেশও করতে পেরেছে। অথচ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সরকার নিষিদ্ধ করেনি, বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী ঘরানার ছাত্র সংগঠনগুলো গায়ের জোরে শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছে। অথচ এসব ছাত্র সংগঠন বা রাজনৈতিক সংগঠনের কোনো আইনগত ক্ষমতা নাই কোনো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার। কিন্তু তাদের হাতে ছিল র্যাব, পুলিশ, বিজিবি এবং যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী। তারপরেও অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির মতো নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রেখে শিবির ছাত্র সমাজ এবং বৃহত্তর জনতার কল্যাণে নীরবে কাজ করে গেছে।
দেশবাসী যখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন যে ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে পুষ্ট হয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্কর জুলুমে দেশবাসীর পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে তখন ঘুরে দাঁড়াবার জন্য শিবির গোপনে কাজ করেছে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শিবির সদলবলে যোগদান করেছে। জুলাই ও আগস্ট বিপ্লবে শিবিরের অনেক কর্মী শাহাদত বরণ করেছেন। বৈষম্য বিরোধী সমন্বয়কদের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে শিবিরের কয়েকজন নেতাও ছিলেন। বস্তুত শিবির যে কোনো মূল্যে স্বৈরাচারকে হটানোর ব্যাপারে ছিল আপোষহীন। প্রযুক্তিগত সাহায্য থেকে শুরু করে জনবল- সব ক্ষেত্রেই শিবিরের যতটুকু সাধ্য ছিল, শিবির সেটা করেছে। আন্দোলনের শেষ দিন অর্থাৎ ৫ আগস্টেও শিবির কোনো কৃতিত্ব নেয়ার চেষ্টা করেনি বা তারা যে সাংগঠনিকভাবে বিপ্লবে যোগ দিয়েছে সেটাও প্রকাশ করেনি।
আজ যেটা প্রকাশিত হয়েছে সেটি ঘটনাচক্রে। আর যখন প্রকাশিত হয়েছেই তখন সত্য নিষ্ঠতার স্বার্থে শিবির সেটিকে গোপন করার চেষ্টা করেনি। বিগত ১৫ বছর ধরে শিবিরের বিরুদ্ধে নানা ইলজাম বা অপবাদ দেয়া হয়েছে। ‘রগ কাটা’ তার অন্যতম। শিবিরি প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু কোনো গণমাধ্যম তাদের প্রতিবাদ ছাপেনি। গণমাধ্যমসমূহের একতরফা দোষারোপের কারণে শিবির সম্পর্কে ছাত্র সমাজ ও মানুষের কিছু অংশের মধ্যে বিভ্রান্তিও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেই বিভ্রান্তি দূর করার মতো কোনো পথ শিবিরের সামনে খোলা ছিল না। সত্য তার আপন মহিমায় একদিন না একদিন উদ্ভাসিত হবেই। তাই শিবিরের ক্ষেত্রেও তার নিঃস্বার্থ কোরবানি এবং জনকল্যাই অন্ধকার ভেদ করে আলোর মুখ দেখেছে।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, জামায়াতের নাম সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান স্বয়ং নিয়েছেন। জামায়াত এক্ষেত্রে কোনো তদবির করেনি। শিবিরের কথাও সেভাবেই আলোর মুখ দেখেছে। শিবিরের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি এস এম ফরহাদ বলেছেন যে “ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতিকে ৫৬ দিনের রিমান্ডে দেয়া হয়, বিভিন্ন শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে গুম করা হয়, ক্রসফায়ার দেয়, মিথ্যা মামলা দিয়ে রিমান্ডে দেয়; কেউ কিছু বলে না। এমন পরিস্থিতিতে ‘তুমি কেন পরিচয় দিচ্ছ না’, এই প্রশ্ন যৌক্তিক নাকি ‘তোমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই’ প্রশ্নটি যৌক্তিক?”
শিবিরের সেক্রটারির এই প্রশ্নের পর আর কারো কিছু বলার আছে বলে মনে করি না। তারপরেও কেউ যদি কিছু বলেন তাহলে আমরা তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো, যে জবাব তাদেরকে সন্তুষ্ট করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।