ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। পতিত মাফিয়া হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্র শাসনের ভার নিয়েছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের প্রথিতযশা কয়েকজন। আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অন্তর্বর্তীকালীন শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটাবে।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সেই কাক্সিক্ষত নির্বাচনটি কখন হবে? নির্বাচন যখন হোক; অত্যাবশক হয়ে পড়েছে রাষ্ট্র সংস্কার। কেউ বলছেন, সংস্কার আগে নির্বাচন পরে। আবার কেউ বলছেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার আসার পরে সংস্কার করা দরকার। তাদের যুক্তি, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে জনগণের সম্মতির ওপর ভিত্তি করে সংস্কার করলে তা বেশি কার্যকর হবে। তবে কথা হলো- নির্বাচন যখনই হোক না কেন, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকাঠামোর সর্বস্তরে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিবাদী শাসন দীর্ঘায়িত করতে রাষ্ট্রের জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ সব প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছেন। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রকে একটি শক্তিশালী পাটাতনে দাঁড়াতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার।
সংস্কার হলো মনস্তাত্ত্বিক ছাপ। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে সংস্কার করতে হবে; যাতে প্রতিটি সংস্থার কর্মীদের কাছ থেকে মানুষ সেবাটা পান। দক্ষ, যোগ্য এবং মেধাবীদের দিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ এমনভাবে সাজাতে হবে; যেন তারা রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে সঠিক কাজ করতে পারেন। প্রয়োজনে আইনের সংস্কার করতে হবে। বাস্তবতা হলো- রাষ্ট্রকাঠামোয় আজ যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা নিরসন না করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তাই একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কারকাজ সম্পূর্ণ করে জনগণের নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে সবার জন্য মঙ্গলজনক।
৫৩ বছর আগে যে কারণে দেশ স্বাধীন হয়েছিল; সেভাবে রাষ্ট্র সাজাতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের নেতৃত্ব। প্রথমে আঘাত আনে শেখ মুজিবের বাকশালি শাসন। গণতন্ত্রের কবর রচনা করে একনায়কতন্ত্রের বীজ তখন রোপণ করা হয়। শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর প্রেসিডেনট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশ একটি জনঘনিষ্ঠ কাঠামোয় আসার পরে এরশাদের স্বৈরশাসন ফের রাষ্ট্রের সব সাংবিধানিক সংস্থা ধ্বংস করে দেয়।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পরও আমাদের নেতৃত্ব দেশ গঠনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে বিগত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন রাষ্ট্রকে খাদে ফেলে দিয়েছে। যার কারণে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় স্বাধীনতা জরুরি হয়ে পড়ে। এর জন্য বিগত ১৫ বছরে সরকারবিরোধী সব দলের নেতারা নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক সাফল্য আসছিল না। অবশেষে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কাছে পরাভূত হয়ে স্বৈরাচারী হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হন। ৫ আগস্ট দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে। অনেকে ছাত্র-জনতার এ বিজয়কে আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করছেন। কিন্তু এর জন্য বহু মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, অনেক পঙ্গুত্ববরণ করেছেন।
সুতরাং, বহু জীবনের বিনিময়ে অর্জিত গণ-অভ্যুত্থান কোনো কারণে যেন ব্যর্থ হয়ে না যায়। শহীদদের বিনিময়ে আজ যে মুক্ত বাতাস, তা যাতে জনগণ উপভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। কাজেই এ অর্জন ধরে রাখতে ঐক্য প্রয়োজন। ফ্যাসিবাদ হয়তো পালিয়ে গেছে; তাদের প্রেতাত্মারা কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গেছে। ষড়যন্ত্র করে রাষ্ট্রের বিশৃঙ্খলা তৈরি করার কাজ তারা করছে এবং তা অব্যাহতভাবে এসব দুরাচারী চালিয়ে যাবে। তাই গণতন্ত্রকামী প্রত্যেক মানুষকে সতর্কতার সাথে সামনে এগোতে হবে। কোনোভাবে ঐক্য বিনষ্ট করা যাবে না। তা না হলে আবারো ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান ঘটতে পারে। ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান আর যাতে না ঘটে, সে জন্য রাষ্ট্রের অনেক কিছু সংস্কার প্রয়োজন।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বৈরতন্ত্র হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্রজনতার সম্মিলিত গণ-অভ্যুত্থানের মূল সুর ফ্যাসিবাদকে হটিয়ে জনবান্ধব গণতান্ত্রিক একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা। রাষ্ট্র ও সংবিধানের এমন কিছু সংস্কার প্রয়োজন, যেখানে জনসম্মতি জরুরি। জনসম্মতির বাস্তব রূপ হলো জাতীয় সংসদ। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও কল্যাণকর এবং রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও কল্যাণকর, দেশের জন্যও কল্যাণকর।
সংস্কার অর্থ মেরামত করা, সংশোধন করা। আমাদের সংবিধান এবং রাষ্ট্রকাঠামোর যে জায়গাগুলোতে সংস্কারের প্রয়োজন তা যেন গ্রহণযোগ্য অর্থে সংস্কার করা হয়। রাষ্ট্রকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যেন জবাবদিহির মধ্যে থাকে। ওই ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে সেই অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করতে হবে। হাসিনা যে কায়দায় ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিলেন কোনো শাসক যেন আর সে রকম না হতে পারেন তার জন্য সাংবিধানিক পরিবর্তন জরুরি হলে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তাই করা উচিত। দেশের মানুষ আর কোনো ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরশাসন বরদাশত করবে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিস্টরা চায় রাষ্ট্রক্ষমতার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। সে লক্ষ্যে তারা পুলিশপ্রশাসন, জনপ্রশাসন, বিচারালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, নির্বাচন কমিশন, সংবাদমাধ্যম ইত্যাদি কব্জায় রাখতে সবধরনের পথ অবলম্বন করে। মুসোলিনি, হিটলার এবং হাসিনার মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত কোনো পার্থক্য নেই। কাজেই এসব প্রতিষ্ঠান যেন আইনের মধ্যে থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সে সংস্কার খুব জরুরি।
হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে ধরালো অস্ত্র ছিল স্বাধীনতার চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি সেজে অন্যদের দমনে রাজাকার তকমা দিয়ে কঠোরভাবে বিরোধী মতকে দমন করা হয়েছে। এমনও নজির রয়েছে, আওয়ামী লীগ করার সুবাদে স্বাধীনতার সময় যার চার বছর বয়স ছিল তাকেও মুক্তিযোদ্ধার খেতাব দেয়া হয়েছে।
বিগত দিনে আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডে নিমজ্জিত হয়ে অন্যকে ঘায়েল করতে নানা শব্দ ব্যবহার করত। যেমন- জামায়াতকে বলা হতো রাজাকারের দল, বিএনপিকে বলা হতো খুনি এবং দুর্নীতিবাজদের দল। প্রকৃত অর্থে গুম-খুনের রাজনীতির সাথে আওয়ামী লীগ জড়িত। আর তাদের দুর্নীতির মাত্রা রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। পতিত সরকার নিজেদের সব অপকর্ম জনচক্ষুর অন্তরালে রাখতে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যদের রাজাকার বানিয়ে হেনস্তা করার পথ বেছে নেয়।
এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতাবিরোধী বানানোর মেশিন এতটা সচল ছিল যে, যাদের জন্ম স্বাধীনতার ৩০ বছর পরে, বৈষম্যবিরোধী পন্থায় চাকরি চাওয়ার অপরাধে তাদেরও রাজাকারের অংশীজন বানিয়ে ফেলে। তাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে এত দিন রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছেন; তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনিব্যবস্থা নিতে হবে। এমনভাবে আইন সংস্কার করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ মুক্তিযুদ্ধকে বিক্রি করতে সাহস না পান। প্রকৃত বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। এর মর্যাদা সমুন্নত রাখা আমাদের দায়িত্ব।
এ লেখার শেষে এসে বলতে চাই, আমাদের সব আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো একটি গণতান্ত্রিক ও আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া। আজকের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণ-অভ্যুত্থানের ফসল। মূল চাহিদা হলো সংস্কারের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্র কায়েম করা। এ ক্ষেত্রে জনগণের ভোটের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার যৌক্তিক সময়ে উপহার দেয়া। বর্তমান সব সংস্কার একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তবেই সার্থক হবে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান। তাই গ্রহণযোগ্য সময়ে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে, যাতে জনগণ বিগত ১৫ বছরের ভোট না দেয়ার ক্ষুধা মেটাতে পারে।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট