ফ্যাসিবাদী আওয়ামী-বাকশালীদের পতনের পর জাতীয় অর্থনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। সকল ক্ষেত্রেই সৃষ্টি হচ্ছে ইতিবাচক ধারা। পতিত সরকারের একদেশদর্শী পররাষ্ট্রনীতি এবং যেকোন মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী মানসিকতার কারণেই বাংলাদেশ বহির্বিশ^ থেকে অনেকটাই একঘরে হয়ে পড়েছিল। পশ্চিমা বিশ^ সহ গণতান্ত্রিক বিশে^র সাথে মাফিয়াতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের কোন সুসম্পর্ক ছিল না। ফলে তারা পড়েছিল অনেকটা লেজেগোবরে অবস্থায়। সঙ্গত কারণেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল জাতীয় অর্থনীতির ওপর। দেশে তীব্র ডলার সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। প্রয়োজনীয় ডলালের অভাবে ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারছিলেন না। ফলে দেশে আমদানি নির্ভর পণ্যের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। এমতাবস্থায় দেশে বড় ধরনের সঙ্কট ও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও নেমে এসেছিল একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে।
স্বৈরাচারী সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণেই বৈদেশিক বাণিজ্যেও রীতিমত মন্দাভাবের সৃষ্টি হয়। রেমিট্যান্স প্রবাহেও ছিল ভাটির টান। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের অন্যতম ও উল্লেখযোগ্য খাত তৈরি পোশাক শিল্পে সৃষ্টি হয়েছিল অচলাবস্থার। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল পোশাক খাত। সর্বোপরি গত কয়েক বছর ধরেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম ছিল, মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমছিল, টাকার দরপতন হচ্ছিল। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর এখন আর সেসব হচ্ছে না বরং সবকিছুতেই চাঙ্গাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখন বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে। বিদেশী ঋণও বাড়বে। সবকিছু মিলিয়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লব ও বৈশি^ক সমর্থনে অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছে। ছাত্রদের এই ত্যাগ এ দেশকে আবার অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে বলে মনে করছেন দেশের আত্মসচেতন মানুষ।
একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, দীর্ঘদিন স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন ছিলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের। তাই ছিল দেশের বিভিন্ন বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা। যুক্তরাষ্ট্র রফতানি আয়ের প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিনই কমছিল পোশাক রফতানিসহ অন্যান্য বিনিয়োগ। এমনকি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ভারতে পালিয়ে গিয়েও শেখ হাসিনা তার পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি দায়ী করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরাচারিনী শেখ হাসিনা। আর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠন করা হয় অন্তর্র্বর্তী সরকার। অবশ্য ড. ইউনূসের দায়িত্ব নেয়ার এখনও দু’মাস হয়নি। কিন্তু এরমধ্যেই বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্থায়ন সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সে ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতিও মিলেছে। পাইপলাইনে আছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। যেগুলো খুব শিগগিরই পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশকে ৩ বিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া বাংলাদেশকে ২০ কোটি ডলারের বেশি উন্নয়ন সহযোগিতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি এ লক্ষ্যে অন্তর্র্বর্তী সরকারের সঙ্গে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) চুক্তি সই হয়েছে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই চুক্তি সই হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক ৭৫০ মিলিয়ন পলিসিভিত্তিক ঋণের প্রস্তাব করেছে। যা দেশ পুনর্গঠনে অসামান্য অবদান রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ছাড়াও ২৫০ মিলিয়ন বিনিয়োগ ঋণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন পলিসিভিত্তিক ঋণের প্রস্তাব করেছে। এর সাথে আরও ২০০ মিলিয়ন বিনিয়োগ ঋণ প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। এদিকে আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সব ধরনের সাহায্য করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন এবং উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে এ জন্য মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের আন্তর্জাতিক অর্থবিষয়ক সহকারী সচিব ব্রেন্ট নেইম্যান বাংলাদেশ সফর করছেন। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশে এটি প্রথম সফর। বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের বাংলাদেশ সফরসহ সম্পর্কের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন দূর করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগাতে পারলে আর্থিকখাতে দেশ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যা হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য রীতিমত মাইল ফলক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র সকল ধরনের সাহায্য করার জোরালো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দাতা সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে মুক্ত হস্তে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক অপর পরাশক্তি চীন এই সরকারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে এবং সে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশটি কাজ করতে শুরু করেছে। জাপান ইতোমধ্যে বড় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কোরিয়াও বর্তমান সরকারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মূলত, চীনের হাতকে আরও প্রশস্ত ও শক্তিশালী করাতে পারলে এবং মধ্যপ্রাচ্য এখন আর্থিকভাবে খুব সচ্ছল আছে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করে বিনিয়োগে আকর্ষণ করানো গেলে দেশে আবার সুদিন ফিরে আসবে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন স্বৈরাচার সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থপাচারের কারণে দেশের যে ভঙ্গুর অর্থ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল তা আবার স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তবে সবকিছু নির্ভর করছে দেশকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার ওপর। আর এই বিষয়টিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ এসেছে সকল মহল থেকেই।
অর্থনীতিবিদরা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ায় ঘুরে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতি। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকাসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে সহায়তা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সহযোগিতার হাতও বাড়িয়েছে। সম্প্রতি জার্মানী জ্বালানি খাতে সহযোগিতার বড় ধরনের আশ^াস দিয়েছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের কোন কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফর অবশ্যই দেশের জন্য বিশেষ কিছু বলে উল্লেখ করেন তারা। তবে সবকিছু নির্ভর করছে দেশের শৃঙ্খলা, সুশাসন এবং গণতন্ত্র কতোটা সমুন্নত রাখতে পারা যায় তার ওপর। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এই সরকারের ওপর অনেক আস্থাশীল। তাই বাংলাদেশকে এই সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে বলে উল্লেখ করছেন এসব অর্থনীতিদরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এতোদিন স্বৈরাচার সরকারের পাশে ছিলো না। তবে বাক স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার নিয়ে আগে থেকেই জনগণের পাশে ছিল। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কোন দেশকে সহায়তা করতে পারে না। এক্ষেত্রে তারা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবিসহ অন্যান্য দাতা সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের ক্ষমতা বা হোয়াইট হাউসের নিজস্ব ক্ষমতায় বাংলাদেশের পাশে থাকতে পারে। ইতিমধ্যে এসব দাতা সংস্থা সেই আশ্বাসও দিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারকে আস্থায় নিয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের রফতানিতে জেনারেলাইজড স্কিম অফ প্রিফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধাকে পুনর্বহালের কথা বলছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের এভাবে সরাসরি পাশে থাকায় অন্যান্য দেশের বিনিয়োগও বাড়বে বলে আশাবাদী তারা। এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকারকে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্বৃত্ত অর্থ দেশে বিনিয়োগের জন্য কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন। তারা আরো বলছেন, আমাদের বিশ্বাস এখন থেকে আমাদের অর্থনীতি শুধু ওপরের দিকেই যাবে, আর নিচের দিকে নামবে না। গত কয়েক বছর ধরেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম ছিল, মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমছিল, টাকার দরপতন হচ্ছিল। এখন আর সেসব হবে না। এখন বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। বিদেশী ঋণও বাড়বে। সবকিছু মিলিয়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লব ও সারা পৃথিবীর সাপোর্টে অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছে। ছাত্রদের এই ত্যাগ এ দেশকে আবার অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে জাতীয় অর্থনীতিতে গতি ফেরার জন্য বাংলাদেশকে ৩ বিলিয়ন ডলার দেবার প্রতিশ্রতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। একই সাথে অন্তর্র্বর্তী সরকারের সংস্কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে ঋণ সহায়তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। চলতি অর্থবছরে নতুন করে আরও ২ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে সংস্থাটি। এর আগে বাংলাদেশের আর্থিক খাত সংস্কারে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেয়ার কথা জানিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতকালে এ প্রতিশ্রুতি দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক অন্তর্র্বতী সরকারের সংস্কার এজেন্ডা বাস্তবায়নের সহায়তা করতে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ঋণ সহায়তা বাড়ানোর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক চাহিদাগুলো পূরণে সহায়তা করবে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, স্বাস্থ্যখাতসহ বেশ কয়েকটি খাতে সহায়তার জন্য নতুন করে এই ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেয়া হবে।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আরো বলেন, নতুন প্রতিশ্রুতি ছাড়াও, বিশ্বব্যাংক সরকারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিদ্যমান কর্মসূচি থেকে আরও অতিরিক্ত প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার পুনর্ব্যবহার করবে। বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর অর্থ পুনর্বিন্যাস হলে চলতি অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে যে সহজ শর্তে ঋণ ও অনুদান দেবে তার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। আর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের সংস্কারে অর্থায়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংককে নমনীয় থাকতে হবে। পাশাপাশি গত ১৫ বছরের ‘চরম অপশাসন’ থেকে মুক্ত হওয়া বাংলাদেশের নতুন যাত্রায় সহায়তা করতে হবে। এছাড়া পতিত শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ স্বৈরশাসনকালে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা বাংলাদেশ থেকে বিলিয়ন ডলারের সম্পদ পাচার করেছে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, পাচার করা এসব অর্থ ফিরিয়ে আনতে প্রযুক্তিগত সহায়তাও দিতে হবে বিশ্ব ব্যাংককে। একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ব্যাংকের দক্ষতা বাড়াতে হবে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়ে কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংস্কার ও ট্যাক্স সংগ্রহের প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন করতে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে বিশ্বব্যাংক। যা নতুন সরকারে বড় একটি অর্জন বলে মনে করা হচ্ছে।
স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনে দীর্ঘদিন রফতানি আয়ের প্রধান উৎস পোশাকখাতের রফতানিতে পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের সবধরনের সহযোগিতার ঘোষণায় পোশাক রফতানিতে নতুনমাত্রা আসবে বলে মনে করেন বিজিএমইএ’র সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। তার ভাষায়, হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনে রফতানি আয়ের শীর্ষ বাজার যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি প্রতিদিনই কমছিল। এই সফর বায়ারদের কাছে নতুন বার্তা দিবে। এছাড়া এবার প্রধান উপদেষ্টার আমেরিকা সফরে জিএসপি পুনর্বহাল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আশাকরা হচ্ছে, আবার জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে বাংলাদেশ। যা পোশাকখাতসহ দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা আনবে। গতি ফিরতে সহায়ক হবে জাতীয় অর্থনীতিতে।
এ বিষয়ে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের সভাপতির বক্তব্য হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বাক স্বাধীনতা নাগরিক অধিকার, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে দেশের মানুষের পাশে ছিল। এখন একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতন এবং নতুন অন্তর্র্বর্তী সরকারের শুরুতে তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক গুরুত্ব আছে। বিশেষ করে ট্রেজারি বিভাগের আন্তর্জাতিক অর্থবিষয়ক সহকারী সচিবের সফর বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের এভাবে সরাসরি অংশগ্রহণ দেশের অর্থনীতিতে আবারও সুদিন ফিরবে বলে উল্লেখ করেন অ্যামচাম সভাপতি। তিনি বলেন, এবারের সফরের প্রধান বিষয় বাংলাদেশের অর্থনীতি। বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভের সঙ্কট আছে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় জটিলতা আছে, রফতানির সঙ্কট আছে। আর তাই দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা পুরোটা তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এবারের সফরকে অর্থনৈতিক দুয়ার খোলার সফর হিসেবে দেখছেন তিনি।
সূত্র মতে, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পলায়ন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে দেশের টাকা পাচার করে দেশকে দেনার সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছেন। ড. ইউনূসের সরকার এর থেকে রেহাই পাওয়ার পথ খুঁজছে। একই সঙ্গে সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করতে চাইছেন ড. ইউনূস। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যা দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের আন্তর্জাতিক অর্থবিষয়ক সহকারী সচিব ব্রেন্ট নেইম্যান বাংলাদেশ সফর করেছেন। যা বাংলাদেশের জন্য নতুন আশাবাদের সৃষ্টি করেছে। মার্কিন প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু, যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ এবং মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের পরিচালক জেরড ম্যাসন। এদিকে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি’র পাশাপাশি আগামী ৩ বছরে বাংলাদেশকে ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তা করবে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি)। এটা একটা প্যাকেজের আওতায় দেয়া হবে বলে জানা গেছে। রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন খাতের জন্য এই অর্থ দেবে তারা। সম্প্রতি সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে এসব জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন। তিনি বলেন, বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আইডিবির রিজিওনাল হাব ম্যানেজার নাসিস সোলাইমান। উপদেষ্টা জানান, ভৌত অবকাঠামোসহ সম্প্রতি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া রাস্তাঘাট নির্মাণে অর্থনৈতিক এ সহায়তা করবে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাতেও সহায়তা করবে তারা। এছাড়া আগামী মার্চের মধ্যে এডিবি ৯০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
স্বৈরাচারি ও ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট ও বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হয়েছিল নতুন সরকারের আমলে তা এখন কেটে যেতে শুরু করেছে। বৈদেশিক রিজার্ভে স্থিতিশীলতা এসেছে। বৈশি^ক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশে ভাবমূর্তি অনেকটাই উজ্জ্বল হয়েছে। দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলো হাত প্রসারিত করতে শুরু করেছে। বাকশালী আমলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকটাই কেটে গেছে। সঙ্গত কারণেই জাতীয় অর্থনীতিতে রীতিমত চাঙ্গাভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে নতুন করে আশার আলো দেখা দিয়েছে। তবে সবকিছু দেশের সুশাসন ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার ওপর। এসব ক্ষেত্রে দুর্বলতা দূর করা না গেলে কোন অর্জনই টেকসই ও কার্যকরি হবে না।