ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের দেড় মাসের বেশি সময় পার হলেও এখনো গ্রেফতার হয়নি অনেক রাঘব বোয়াল। এরমধ্যে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী ছাড়াও রয়েছেন কয়েকজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের অনেকের নামে একাধিক মামলাও করা হয়েছে। কিন্তু এখনো তারা ধরা পড়েনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে-এ সংখ্যা দুই ডজনের বেশি। তবে এরই মধ্যে সাবেক কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি এবং পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েক দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখনো কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রথেকে জানা গেছে।
গত ১৮ আগস্ট আন্তঃবাহিনী সংযোগ পরিদপ্তর- আইএসপিআর জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মন্ত্রী, এমপি, আমলা, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে ৬২৬ জন সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে ছিলেন। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ৬১৫ জন স্ব-উদ্যোগে সেনানিবাস ত্যাগ করেছেন। তবে এরপর রাঘব বোয়ালদের বড় একটি অংশ এখনো ধরা পড়েনি।
ক্ষমতা হারানোর পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলা হয়েছে, যেগুলোর বেশির ভাগই হত্যা মামলা। এছাড়া গণহত্যা এবং অপহরণের মতো অভিযোগেও মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব মামলার আসামির তালিকায় তার শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামও রয়েছে। একইভাবে নাম রয়েছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ অনেক নেতাদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকেই আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য অবৈধভাবে দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। পতনের কয়েকদিন আগে থেকেই কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।
ইতিমধ্যে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সীমান্ত পাড়ি দিয়েছেন।
এদের আগে (৫ আগস্টের পর) দেশ ত্যাগ করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল), সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ (নাসিম) ও আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ অনেকে। যারা পালিয়ে গেছেন বা পালানোর চেষ্টায় আছেন, তাদের প্রায় সবাই হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামী। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, সরকার পতনের এত দিন পরও কীভাবে এসব ব্যক্তি দেশ ছেড়ে পালাতে পারছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতার দেশ ছাড়ার গুঞ্জন রয়েছে। তবে তাদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেরই ধারণা, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপর ওবায়দুল কাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয় নেন। পরে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত চলে যান। সাবেক একজন মন্ত্রী বলেছেন, তিনি শুনেছেন ওবায়দুল কাদের এখন দুবাই আছেন। শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় ও সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দিন ও তার ছেলে শেখ সারহান নাসের (তন্ময়), হেলালের ভাই সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল এবং আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে ও বরিশালের সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ এখনো দেশ ছাড়ার সুযোগ পাননি। তারা দেশের ভেতরে আছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। শেখ হাসিনার আরেক আত্মীয় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের কিছুদিন আগেই ভারতে চলে যান। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ৩ আগস্ট রাতে পরিবারসহ দেশ ছাড়েন। তিনি ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর যান। তার পরিবার পৃথক ফ্লাইটে যায় লন্ডনে। তাপসের ভাই যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস (পরশ) সরকার পতনের কয়েক দিন আগে, ৩১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরেছিলেন। তিনিও দেশে আছেন বলে জানা গেছে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও আন্দোলনের সময় সপরিবার সিঙ্গাপুরে চলে যান। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের (বিপু) অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। তবে তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান অবশ্য সরকার পতনের পর শুরুতেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিদেশ যাওয়ার চেষ্টাকালে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদও। এখন পর্যন্ত মোট ৩২ জন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। ৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়েছেন আওয়ামী লীগের এমন অন্তত ১৫ কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের নাম বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। অবৈধ পথে দেশ ছাড়ায় ইমিগ্রেশন বিভাগের নথিতে তাদের দেশত্যাগের তথ্য নেই। এর বাইরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং অন্যান্য সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের মধ্যে অন্তত ২৭ জনের দেশ ছাড়ার খবর জানা গেছে। তবে দেশ ছেড়ে পালানো ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা কয়েক শ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ৫ আগস্টের কিছুদিন আগে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে আর দেশে ফেরেননি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের এমন অন্তত ১৩ নেতার নাম জানা গেছে। কিন্তু সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুন হারুন উর রশীদ এখনো ধরা পড়েনি। তারা গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে পুলিশের কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি।
আন্তঃবাহিনী সংযোগ পরিদপ্তর- আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। এ সময় প্রাণনাশের আশঙ্কায় ২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ৫ জন বিচারক, ১৯ জন অসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা, ২৮ জন পুলিশ অফিসার, ৪৮৭ জন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্য, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ সর্বমোট ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় প্রদান করা হয়। ‘পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় ৬১৫ জন সেনানিবাস ত্যাগ করেছেন, ৪ জনকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ/মামলার ভিত্তিতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে আশ্রয়প্রাপ্ত ৩ জন তাদের পরিবারের ৪ জন সদস্যসহ মোট ৭ জন সেনানিবাসে অবস্থান করছে। আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সকল তথ্যাদি প্রদান করা হয়েছে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে সেনাবাহিনী জানায়, মূলত জনরোষ থেকে প্রাণ বাঁচাতে এই আশ্রয়স্থল বেছে নিয়েছেন আশ্রয়প্রার্থীরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী তাদের আশ্রয় দিয়েছে। পাশপাশি আশ্রয়প্রার্থী কেউ অভিযুক্ত হলে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে।