মৌসুমে চাল মজুদ করে পরে বেশি দামে বিক্রি করতে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। নওগাঁ জেলার বিভিন্ন গুদামে অবৈধভাবে ধান-চাল মজুদের হোতা ছিলেন তিনি। নিজের ভাই-বোন ও আত্মীয়দের নিয়েই এই সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করে চালের বাজার অস্থির করে বাড়তি মুনাফা লুটে নিতেন সাধন।
শুধু যে চাল সিন্ডিকেটেরই হোতা ছিলেন তা-ই নয়, তিনি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নওগাঁ অস্থায়ী ট্রাক টার্মিনালের জায়গা হস্তান্তর করে আবাসিক এলাকায় টার্মিনাল বানান। এর মাধ্যমে ট্রাক শ্রমিক-মালিকদের কাছ থেকেও বিপুল অঙ্কের টাকা লুটে নেন। এ রকম আরো অসংখ্য অনিয়ম-দুর্নীতির নায়ক বনে যান সাধন চন্দ্র। নওগাঁ ঘুরে এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী, জেলায় সচল চালকলের সংখ্যা ৫৭১। এর মধ্যে ৫৩টি অটোমেটিক এবং ৫১৮টি হাসকিং মিল। এসব মিলে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই হাজার টন চাল উৎপাদন হয়। নওগাঁর ১১ উপজেলায় স্থানীয় ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা ছিল ৮০০ টন চালের।
এই চাহিদা মেটানোর পর উদ্বৃত্ত চাল দেশের বিভিন্ন মোকামে সরবরাহ করার কথা ছিল। তবে এই চক্রের সদস্যদের মজুদদারির কারণে বছরের পর বছর ধরে চালের বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী এবং তাঁর আত্মীয়রা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে পকেটে ভরেছে কোটি কোটি টাকা।
নওগাঁ জেলার চাল ব্যবসায়ী মানিক প্রামাণিক বলেন, ‘সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ক্ষমতায় থাকাকালে বড় বড় মিলাররা গোডাউনে হাজার হাজার টন পুরনো চাল ও ধান মজুদ করে রাখতেন। তাঁদের সিন্ডিকেটের কারণেই চালের বাজারে কখনোই অস্থিরতা কাটেনি।
এসব করে তাঁরা সে সময় শত শত কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন।’
নওগাঁর পোরশার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, সাবেক মন্ত্রীর ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা এবং তাঁর সিন্ডিকেট সদস্যরা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সব দরপত্র বাগিয়ে নিতেন। এ কারণে নওগাঁর বেশির ভাগ চালকল মিল মালিক মন্ত্রীর ওপর নাখোশ ছিলেন।
নওগাঁ শহরের সুলতানপুর মহল্লার ঘোষ অটোমেটিক রাইস মিলে বিগত সময়ে বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার টন চালের মজুদ থাকত। মিলটির মালিক দ্বিজেন ঘোষ নিজেকে পরিচয় দিতেন সাধনের আত্মীয় হিসেবে। সরকার পতনের পর এখন তাঁকে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না।
নিয়ামতপুরে সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর ভাই মনোরঞ্জন মজুমদারের চালের মিল রয়েছে। তিনি এলাকায় মনা মজুমদার নামে পরিচিত। তাঁর কথামতো চলতেন বড় বড় চাল ব্যবসায়ীরা। চালকল ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলামও নিজেকে পরিচয় দিতেন আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে। নিয়মবহির্ভূতভাবে ধান-চাল মজুদ রাখার অভিযোগ থাকলেও কখনো এঁদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়নি।
সাবেক মন্ত্রীর ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা সুলতানপুর মহল্লায় সুফিয়া অ্যাগ্রো অ্যারোমেটিক অটোমেটিক রাইস মিল নামের বড় একটি চালকলের মালিক। জেলায় যত অবৈধ মজুদদার রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই মনার কারণে হয়েছেন প্রভাবশালী। চক্রটি সব সময় নিজেদের সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের ঘনিষ্ঠজন পরিচয়ে সিন্ডিকেট পরিচালনা করেছিলেন। প্রশাসন মজুদবিরোধী অভিযানে কখনো তাঁদের বিরক্ত করেনি।
আপত্তির মধ্যেও ট্রাকস্ট্যান্ড করে হাতিয়ে নেন টাকা : এদিকে শুধু চাল সিন্ডিকেটই নয়, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্রের অসংখ্য অনিয়মের আরেকটি হলো নওগাঁ অস্থায়ী ট্রাক টার্মিনালের জায়গা হস্তান্তরের বিষয়টি। নওগাঁ শহরের পার-নওগাঁ টিঅ্যান্ডটি আবাসিক এলাকায় ট্রাক টার্মিনালটি স্থাপন না করতে এলাকাবাসী দাবি জানায়। আবাসিক এলাকায় ট্রাক টার্মিনাল স্থাপন করলে পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে—এমন অভিযোগ শহরবাসীর। অন্যদিকে ট্রাক চালক-শ্রমিক-মালিকরা ট্রাকস্ট্যান্ড শহরের বাইরে স্থাপন করার দাবি তুলে ধরেন। এই দাবি প্রায় ২০ বছরের। ২০ বছর পর ২০২২ সালে নওগাঁ শহরের পার-নওগাঁ টিঅ্যান্ডটি অফিসের পাশে সরকারি প্রায় ১৪ বিঘা জমি জেলা ট্রাক পরিবহন মালিক গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করেন সাবেক জেলা প্রশাসক মো. হারুন-অর-রশীদ। জায়গা বুঝে পেয়েই সেখানে ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। আর এই টার্মিনাল নির্মাণের প্রতিবাদে ২০২২ সালের মার্চ মাসে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী। এলাকাবাসীর প্রতিবাদের মুখেও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এই জমিটি ট্রাক মালিকদের নিয়ে দিতে মধ্যস্থতা করেছিলেন। তিনি একক ক্ষমতা প্রয়োগ করে জেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এই ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে সময় নওগাঁ জেলা শহরে ব্যাপক সমালোচিত হয়ে পড়েন প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এই টার্মিনাল নির্মাণের জায়গাটা বন্দোবস্ত করেছিলেন তিনি। ট্রাক মালিকদের পক্ষে রাখতে এবং নিয়মিত মাসোহারা পেতে এই কাজ করেছেন। নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় একটি অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এই অর্থনৈতিক জোনের বেশির ভাগ জমিই খাদ্যমন্ত্রীর নিজের লোকজনের। মন্ত্রীর লোকজন আগেই জমি কিনে নেন কম দামে। পরে সেটি অর্থনৈতিক জোন ঘোষণা করা হলে অধিগ্রহণের সময় দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে লাভবান হবেন—এই আশায়। এতে সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও টাকা যাবে মন্ত্রীর পকেটে। নওগাঁ জেলায় হাজার কোটি টাকার সিএসডি নির্মাণের তথ্য জনগণ জানে না। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাবিটা ও টিআর কর্মসূচির বিশেষ খাতের অর্থে মানবিক সহায়তায় নওগাঁর ১১ উপজেলার অসচ্ছল, হতদরিদ্র, ঘরহীন, নদীভাঙনসহ বিভিন্ন দুর্যোগে গৃহহীন পরিবার, বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত নারী, প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষ, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবারসহ ২১১টি পরিবারের জন্য পাকা বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল ২০১৯ সালে। এসব অসচ্ছল পরিবারের নিজস্ব ৩ শতক জমিতে ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি বাড়ি নির্মাণে সরকারের খরচ হয় দুই লাখ ৫৮ হাজার ৫৩১ টাকা। কিন্তু এসব বাড়ি নির্মাণে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। নওগাঁর জনপ্রতিনিধির অনেকেই টিআর, কাবিখার বরাদ্দের বিষয়টি নিয়ে নাখোশ। যেখানে প্রয়োজন সেখানে বরাদ্দ পাচ্ছিলেন না। যেখানে সাধন চন্দ্রের লোক রয়েছে সেখানেই এই খাতের বরাদ্দ প্রদান করা হতো। আর এই কাজ করতেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা এবং মন্ত্রীর মেয়ের জামাই নওগাঁ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহম্মেদ। নাসিম আহম্মেদ মুসলিম হলেও খাদ্যমন্ত্রীর মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পরই আবার খাদ্যমন্ত্রী ক্ষমতা দেখিয়ে মেয়ের জামাইকে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করে শহর দখলে রাখতেন।
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/09/28/1429654