গত জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত বিপ্লবকে ভারত সরকার এবং ভারতের প্রায় সব বুদ্ধিজীবী মেনে নিতে পারেননি। বাংলাদেশের বিপ্লব সম্পর্কে ভারতের বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীর অবস্থানও নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপির কাছাকাছি চলে গেছে। কিছুদিন আগে রাহুল গান্ধী যখন ৪ দিনের আমেরিকা সফরে যান তখন তিনি বলেন, বাংলাদেশে চরমপন্থীদের বিষয় নিয়ে ভারতে উদ্বেগ রয়েছে। সেই উদ্বেগ তাদের মধ্যেও কিছুটা আছে। মিসেস ভিনা সিক্রি এক সময় বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি জুলাই আগস্ট বিপ্লব সম্পর্কে বলেন, ছাত্র শিবির রাস্তায় নেমে আসে এবং প্রচন্ড সহিংসতা শুরু করে। তার মতে ছাত্ররা এই সহিংসতায় (তাদের মতে এটা কোটি কোটি মানুষের বিপ্লব ছিল না, ছিল ভায়োলেন্স) ড্রাইভিং সিটে ছিল না। অর্থাৎ এই বিপ্লবের নেতৃত্বে ছাত্ররা ছিল না।
একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ভিনা সিক্রিকে বলেন যে, বাংলাদেশের মানুষ আজ ১৯৭১ সালকে আর স্মরণ করে না। তিনি ভিনা সিক্রিকে প্রশ্ন করেন, জামায়াতে ইসলামী কি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেতরেও অনুপ্রবেশ করেছে? জবাবে ভিনা সিক্রি বলেন, ওহ! অবশ্যই। সঞ্চালক প্রশ্ন করেন, আমেরিকা শেখ মুজিবের হত্যাকারীগণকে বাংলাদেশের কাছে প্রত্যর্পণ করছে না কেন? তিনি স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশে প্রচন্ড ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্ট রয়েছে। ভিনা সিক্রি বলেন, বাংলাদেশী জনগণ ১৯৭১ সালকে ভুলে গেলেও আমরা ভুলে যাইনি।
ভিনা সিক্রি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত শান্ত ছিল। শেখ হাসিনা চাকরির কোটা সম্পর্কে ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা ভারত এবং চীন থেকে ফিরে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সেই সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি রাজাকার শব্দটি উচ্চারণ করেন। ছাত্র এবং জনতা তাকে ভুল বুঝে এবং আন্দোলনের সকলকেই রাজাকার বলা হয়েছে বলে অপপ্রচার চালায়। ভিনা সিক্রি শেখ হাসিনার ভাষা ধার করে বলেন, ছাত্রলীগ ১৭ জুলাই রাস্তায় নামলে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাথে সংঘর্ষ হয়। এর পরদিন ইসলামী ছাত্র শিবির এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ বিরোধী দল রাস্তায় নেমে আসে এবং সমগ্র ঢাকা শহরে তুলকালাম কা- ঘটায়। এর পর থেকেই ছাত্র আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে ইসলামী ছাত্র শিবিরের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
এরপর সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দেন সেই রায়ে ছাত্রদের দাবি সম্পূর্ণ মানা হয়। ভিনা সিক্রির মতে তারপরেও ইসলামী ছাত্র শিবির শেখ হাসিনার ক্ষমা প্রার্থনাসহ নতুন নতুন দাবি তোলে। এমনকি তারা আন্দোলনের এই পর্যায়ে শেখ হাসিনার পদত্যাগও দাবি করে। এভাবে আন্দোলন গড়াতে গড়াতে আগস্ট মাস শুরু হয় এবং সেনাবাহিনী এই আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি গ্রুপ আছে যারা জামায়াতপন্থী। সেনাবাহিনীর এই গ্রুপটি আপার হ্যান্ড পায়। তারা সেনাপ্রধানের কাছে বলে যে, তারা জনগণের ওপর কোনো গুলী ছুঁড়বেন না এবং শেখ হাসিনাকে যেতেই হবে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর উন্মত্ত জনতা, যাদের নেতৃত্বে ছিল ইসলামী ছাত্র শিবির, তারা মুক্তিযুদ্ধ এবং শেখ মুজিবের যেখানে যত চিহ্ন ছিল, সর্বত্র তার সবগুলো ধ্বংস করে দেয়।
৫ আগস্টের পর শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশ ইসলামী ছাত্র শিবির এবং জামায়াতে ইসলামীর দখলে চলে যায়। তারা হিন্দুদেরকে ধমক দিয়ে বলে যে, তারা যেন বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে যায়।
॥ দুই ॥
ভিনা সিক্রি কথা বলেছেন ৪৫ মিনিট ধরে। ঘুরে ফিরে সেই একই কথা। জামায়াত আর ছাত্র শিবির। আমরা তার ৪৫ মিনিটের বক্তব্যের সারসংক্ষেপ তুলে দিলাম। এবার আসছি আরেক ভারতীয় সুধীর লেখায়। তার নাম ব্রহ্ম চেলানি। তিনি ৯ টি পুস্তক রচনা করেছেন। তাকে সারা ভারতে এমনকি আমেরিকা ও ইউরোপেও একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি বলে বিবেচনা করা হয়। সেই ব্রহ্ম চেলানি বাংলাদেশের এত বড় নজিরবিহীন গণবিপ্লবকে সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান বলে সরাসরি বলেছেন। ব্রহ্ম চেলানি প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে একটি লেখা দিয়েছেন, যার শিরোনাম A quiet military coup in Bangladesh. অর্থাৎ বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর নীরব অভ্যুত্থান। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের অনেক মিডিয়ায় বলা হয়েছে যে, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। কিন্তু তারা এই পতনের পেছনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা এড়িয়ে গেছে। ব্রহ্ম চেলানি কোনো রকম রাখঢাক না করে লিখেছেন, In reality, the regime change in the world’s eighth most-populous country amounts to a quiet military coup behind a civilian facade. অনুবাদ: বাস্তবে পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম জনঅধ্যুষিত দেশে বেসামরিক নাগরিকের মুখোশের আড়ালে একটি নীরব সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে গেছে।
তিনি লিখছেন, আসলে ইন্টারিম সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের নাম ঘোষণা করা হয়েছে এই অভ্যুত্থানের পেছনে সামরিক বাহিনীর ভূমিকাকে আড়াল করার জন্য। এই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা যে যাই বলুন না কেন, আসলে তারা সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকারুজ্জামানের নির্দেশ পালন করছেন। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলতে হয় যে ইসলামপন্থী দলসমূহের সমর্থনপুষ্ট ছাত্রদের আন্দোলন হাসিনার ১৫ বছরের ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে উৎখাত করেছে। হাসিনা যাতে করে নিরাপদে দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন সে ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছে সেনাবাহিনী। যে মুহূর্তে ৭৬ বছর বয়স্ক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ভারতের উদ্দেশে একটি সামরিক পরিবহন বিমানে ওঠেন তখন থেকেই শেখ হাসিনার অফিসিয়াল সরকারি বাসভবন উন্মত্ত জনতা লুট করে।
ব্রহ্ম চেলানি অতঃপর বলছেন, হাসিনাকে নির্বাসনে পাঠানোর ঘটনা মিলিটারির তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। বরং এটি ছিল পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনী কর্তৃক দেশের শাসনভার গ্রহণের একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা। সামরিক নেতৃবৃন্দের কাছে হাসিনাকে হত্যা করা অথবা তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করার চেয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোটাই তাদের কাছে সুবিধাজনক মনে হয়েছিল।
সামরিক বাহিনী এবং ইসলামী জঙ্গীদেরকে হাসিনা নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। কিন্তু সেনাপ্রধান ছাত্র আন্দোলনকে জনতার সহিংসতায় (মব ভায়োলেন্স) পর্যবসিত করে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীকে অকার্যকর করে তুলেছিলেন। অবশ্য এই অভ্যুত্থানের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে হাসিনা এই বলে আত্মতৃপ্ত ছিলেন যে, তিনি তার কাজিনকে জেনারেল ওয়াকারুজ্জামানের সাথে বিয়ে দিয়েছেন এবং তিনিই ওয়াকারুজ্জামানকে সেনাপ্রধান বানিয়েছেন।
এরপর ব্রহ্ম চেলানি ভারতের সেই বহু চর্চিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের বয়ান দেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার পতনের ফলে বাংলাদেশ প্রায় অচল হওয়ার পর্যায়ে যায়। লুট, উচ্ছৃঙ্খলতা, সহিংসতা, জিঘাংসা এবং দীর্ঘ সময় ধরে সংখ্যালঘুদেরকে হত্যা করা হয়। হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে গেলে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারুজ্জামান দৃশ্যপটে আসেন এবং তার সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামান।
ব্রহ্ম চেলানির মতে সেনাবাহিনীর এই নীরব অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়নই শুধুমাত্র কঠিন হবে না, বরং সেনাবাহিনীর ওপর বেসামরিক প্রশাসনের যে সামান্যতম নজরদারিও ছিল সেটিও কর্পুরের মতো উড়ে যাবে। তৎসত্ত্বেও একটি মার্কিন বান্ধব সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছে, যে আমেরিকা গণতন্ত্র সংকোচনের নাম করে শেখ হাসিনার সরকারকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছে।
সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযানের পরেও দেশটি এখনও বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। দেশটির সামনে এখন প্রধান কাজ হলো উচ্ছৃঙ্খল জনতার ব্যাপক সহিংসতার ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এবং আইন শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
॥ তিন ॥
এই ছিল ব্রহ্ম চেলানি এবং ভিনা সিক্রির কাল্পনিক বয়ান। এদের প্রোপাগান্ডা এত ডাহা মিথ্যা এবং আজগুবি ও বানোয়াট যে, এগুলোর জবাব দিতেও রুচিতে বাধে। তারপরেও জবাব দিতেই হয়। কারণ তাদের সামাজিক মাধ্যম বা ইউটিউব সারা বাংলাদেশে দেখা যায়। ব্রহ্ম চেলানিদের মতো বুদ্ধিজীবীদের লেখা বাংলাদেশের মেইন স্ট্রিম পত্রিকা বলে পরিচিত মিডিয়াতেও দেখা যায়। তাই দুটো কথা বলতেই হয়।
ভিনা সিক্রি কোথায় পেলেন যে, এই আন্দোলন করেছে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবির? তিনি কোথায় পেলেন যে, শেখ হাসিনার পতনের পর সারাদেশের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছে ইসলামী ছাত্র শিবির এবং জামায়াতে ইসলামী? বিদেশীরা তো দূরের কথা, বাংলাদেশের যে কোনো সাধারণ একজন মানুষও দেখতে পাচ্ছেন যে, জামায়াত বা ছাত্র শিবির নয়, বিপ্লবের অব্যবহিত পর ট্র্যাফিক কন্ট্রোল ও হিন্দুদের ঘর বাড়ি ও মন্দির রক্ষা করেছে সাধারণ ছাত্র এবং শিবির ও মাদ্রাসার ছাত্ররা। বাংলাদেশের পুলিশের সংখ্যা আড়াই লক্ষ। শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ প্রায় সপ্তাহ খানিক তাদের কাজে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকে। কারণ তারা শেখ হাসিনার দলের সাথে এমনভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়ে যে, মানুষ তাদেরকে আওয়ামী পুলিশ ভাবতে শুরু করে। এই ভয়ে তারা কয়েক দিন কর্মবিরত থাকে। এরপর পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী কাজে যোগ দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
ব্রহ্ম চেলানির লেখা পড়ে মনে হয় যে, হয় তিনি অকাট মূর্খ, না হয় তিনি তার চোখের মাথা খুইয়েছেন। সারা বিশ^ এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখছেন যে, বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, যাকে হাসিনা ভারতের আজ্ঞাবহ করার চেষ্টা করেছিলেন, সেই সেনাবাহিনীও দেশকে নতুন করে গড়ার কাজে বন্ধুর মতো জনগণের পাশে রয়েছেন এবং ড. ইউনূসের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য দেখিয়ে যাচ্ছেন।
ড. ইউনূস সঠিকভাবেই বলেছেন যে, গত ৫ আগস্টের বিপ্লব এবং শেখ হাসিনার পলায়নের পর বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই মুহূর্তে ছোটখাটো মতভেদ থাকলেও বাংলাদেশের সবগুলো রাজনৈতিক দল দেশের সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কারের জন্য ব্যস্ত রয়েছেন। তারা ইউনূস সরকারকে সব রকম সহযোগিতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী সারাদেশ ঘুরে ঘুরে বিপ্লবে নিহত এবং আহতদের পরিবারকে সাধ্যমত সাহায্য করছেন।
বাংলাদেশের এই সুন্দর এবং সৌভ্রাতৃত্বমূলক পরিবেশ দেখে হিংসায় জ¦লে পুড়ে মরছেন ভারতীয়রা। ভিনা সিক্রি ও ব্রহ্ম চেলানির আজগুবি বক্তব্য সেই হিংসারই নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।