১৯৭২ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কখনো কি এমন কোনো সংস্কার-সংশোধন সম্পন্ন হয়েছে, যা থেকে ১৯৭২ পূর্ব ও পরবর্তী সময়ের মধ্যে তেমন কোনো মৌলিক পার্থক্য-প্রভেদ খুঁজে পাওয়া যাবে। সবই তথৈবচ। এ দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘যে লাউ সেই কদু’; অর্থাৎ, পার্থক্য কিছু নেই! আপাতত লাউ-কদুর বয়ানটা এখানেই থাক। সার কথাটা এভাবে বলা যেতে পারে, গত ৫০-৫২ বছরে এখানে এমন কিছু কি করা হয়েছে যাকে নিয়ে শির উঁচু করে বলা যাবে, এটা অনন্য, অসাধারণ! বরং শোনা গেছে, ‘শৈবাল দীঘিরে বলে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।’ এসব কথা শোনা যাচ্ছে গত ১৫-১৬ বছর ধরে। কলের গানের ভাঙা রেকর্ডের মতো বারবার বহুবার বাজানো হয়েছে। তবে হ্যাঁ, গত ১৫-১৬ বছরে অবশ্য অনেক কিছুর রেকর্ড ভেঙেছে। যেমন ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’-এর সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই অনবরত বেড়েছে। তাদের বিত্তবৈভব অদৃশ্য আলাদিনের চেরাগের জাদুতে হিমালয়ের চূড়া স্পর্শ করেছে। আকাশের তারাও হয়তো গোনা যেতে পারে; কিন্তু পতিত প্রধানমন্ত্রীসহ ও তার সুহৃদ সুজন, যারা দেশ থেকে পালানোর পূর্ব পর্যন্ত যে বিপুল অর্থ পাচার করেছে তার হিসাব কোনো সুপার কম্পিউটার দিয়েও বের করা যাবে কি না সন্দেহ রয়েছে। গত ১৫ বছর সাত মাস ধরে কত সহস্র দুর্বৃত্তায়নের ঘটনা যে ঘটেছে তার শিকার হয়ে এ দেশের বেশুমার মানুষের জীবনাবসান ঘটেছে। পতিত প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুচর অনুগামীদের কোপানলে পরে লাখ লাখ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে। পতিত প্রধানমন্ত্রী ও তার যত কীটপতঙ্গের বিষ কত মানুষের সংসার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে তার শুমারি হওয়া ছাড়া অনুমান করাও সম্ভব নয়।
এসব যত দুষ্কর্ম দুরাচারীরা ঘটিয়েছে তার প্রধান ও একমাত্র কারণ- পতিত প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে অনন্তকাল পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা, সুরক্ষিত করা। যাতে রক্তচোষার দল মানুষের রক্ত শুষে রক্তশূন্য ও নির্বীর্য করতে পারে। কেউ যাতে আর কোনো দিন কোনোকালে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের স্বপ্নটুকুও দেখতে না পারে। এটাকে এক কথায় বলতে হবে, নীতিভ্রষ্টতা, নীতিবিবর্জিত হওয়া। মানুষ এবং প্রাণিকুলের সাথে পার্থক্য নির্ণয়ের অন্যতম একটি সোপান বা মাপকাঠি একমাত্র নীতিবোধ। অতীতে কখনোই নীতিনৈতিকতার অনুশীলন তেমন কাক্সিক্ষত পর্যায়ে না থাকলেও গত প্রায় ১৬ বছর নীতি, বিবেক, বিবেচনাকে পুরোপুরি নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। পরিবর্তে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল আইয়ামে জাহিলিয়াত।
আজ যে সংস্কার-সংযোজনের সুরধ্বনি মাটিতে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, সেই সাথে এক অনুপম স্পন্দন সৃষ্টি হয়েছে, ভাঙা কেল্লায় আশাবাদের নতুন সবুজ নিশান উড়ছে। হাওয়ার দোলায় সে নিশান দোল খাচ্ছে। সেই সাথে সেই মানুষের হৃদয়ে হিল্লোল জাগাচ্ছে। মানুষের দেহমনে তৈরি করছে আশাবাদের প্রত্যয়ী এক অনুভূতি। যাদের গ্রহণযোগ্যতা যত বেশি তাদের কাছে সবার প্রাপ্তি প্রত্যাশার স্বপ্নজালটাও বিস্তৃত থাকে। এই স্বপ্নসাধ পূরণের জন্য প্রয়োজন এক নীতির। সংস্কার সংশোধনের যে উন্মেষ ঘটছে তার সাথে নীতির কোনো সংযোগ না থাকলে সেই উন্মেষ পূর্ণতা পাবে কিভাবে? সংশোধনের সেই ভিত্তি মজবুত করতে আর যত অনুষঙ্গ রয়েছে, সেখানে নীতি-আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রাধান্য না থাকলে ভিত্তিটা মজবুত হবে কিভাবে; যদি না সেই নীতি-আদর্শ নির্ণীত হয়? তখন সেটি স্রোতস্বিনী নদীতে শেওলার মতো ভেসে যেতে সময় লাগবে না। তাহলে এত প্রাণ দেয়া, এত গান শোনা, এত দেয়াল লিখন পাঠ- সব তো অসার অর্থহীন হয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ যখন প্রশ্ন করবে, এত ত্যাগতিতিক্ষা বৃথা গেল কেন। তখন কী তার জবাব হবে।
এখনই যদি আত্ম অনুসন্ধান, আত্মজিজ্ঞাসার অনুশীলন না করা হয়, ছাত্র-জনতা সৈনিকদের আত্মদান ও ভূমিকার পেছনে দর্শন কী ছিল। সেটি নিশ্চয়ই ছিল, বৈষম্যের অবসান, সমতার দাবি, মানবিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হওয়া, মানুষকে সম্মান করা। মূল কথা, একটি সুনীতির উন্মেষ ঘটানো। এসব কিছুর প্রতিবন্ধক ছিল কেবল স্বৈরাচার। এর বিরুদ্ধে লড়তে কাতারবন্দী হয়েছে স্বৈরাচারের দোসর ছাড়া আর সবাই। যে সুনীতির সন্ধানে সবাই ঘর থেকে পথে নেমে আসে সেই সুনীতি প্রতিষ্ঠা না করে, তাকে পথে ফেলে ঘরে ফেরা সম্ভব হতে পারে কি? তাই সুনীতির প্রতিস্থাপন এতটা জরুরি। এখন তো আর সুনীতির প্রতিপক্ষ আছে বলে জানা নেই, তবে হেলা কেন?
তবে যা কিছু বলা হলো, সেটি মুদ্রার উজ্জ্বল একটি দিক। মুদ্রার অপর পিঠটা ঘষামাজায় এখন অনেকটা ঘোলাটে হয়েছে বটে; কিন্তু ঝাপসা থেকে আর যাতে কখনো স্পষ্ট হয়ে উঠতে না পারে সে জন্য ঘষামাজাটা অব্যাহত রাখতে হবে। কখনোই যাতে সেই পিঠটা স্পষ্ট হয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে না পারে এই নীতির চর্চাটা থাকতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সফল এই সরকার, একটা অভ্যুত্থান-উত্তর সরকারের মেয়াদ নির্ণীত হয় বৃহত্তর জনতার অভিপ্রায় আর অভিব্যক্তির ওপর। আমজনতার চাওয়াপাওয়াকে সাধ্যমতো পূরণ সরকারের এখন প্রথম দায়। যে সম্মান মর্যাদা মানুষ হারিয়েছে বিগত দিনে তার পুনরুদ্ধার ও পূর্ণতা ফিরে পেতে মানুষ এখন অধীর। সম্মান সমিহ লাভের সাথে শৌর্যের সম্পর্ক নিবিড়। এই দুই পরিপূরককে সমানভাবে এগিয়ে নেয়া হবে সমানতালে, দৃঢ় পদে। এ নিয়ে এখনো বিশ্বাসের কোনো চিড় ধরেনি।
যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের বারবার ফিরে আসার একটি গভীর আশা মনে থাকে। তাই তাদের অনেকের মন জুগিয়ে চলা, দেয়াথোয়ার হিসাব করা, তারপর ব্যবস্থা করে তাদের চলতে হয়। এতে মানুষের কী লাভ-ক্ষতি সে হিসাব তারা কমই করে। তবে বর্তমান সরকার জানে তাদের কেবল একটিই মেয়াদ। ব্যক্তিবিশেষের নয়, সমষ্টির প্রয়োজন পূরণ করে মানুষের হৃদয়ে ও ইতিহাসের পাতায় তারা স্থান করে নেবে। রাস্তার ব্যানারে, রাজনীতির মিছিলে, প্ল্যাকার্ডে পোস্টারে তাদের ছবি হয়তো ক্ষণস্থায়ী হতে পারে। এগুলো চিরস্থায়ী করার কোনো অভিলাষ অবশ্যই তাদের নেই। তবে লক্ষ করা যাচ্ছে, কিছু খবরশিকারিী (!) তাদের চোঙ্গা হাতে নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীলদের কথা আদায় করতে শশব্যস্ত। সব খবরশিকারির উদ্দেশ্য কিন্তু খবর শিকার নয়। যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। এটা কারো নীতি হতেও তো পারে। এখন তো এখানে নীতির বড় আকাল। সুনীতি দরকার। আর যত কূনীতিকে বিদায়ের ব্যবস্থা করতে বিলম্ব হওয়া উচিত নয়।
সংযম সংযত আচরণ আমাদের কাছ থেকে এখনো অনেক দূর, বোধ-বিবেচনা, সেটিও এখনো দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তালাশ করতে হয়। সাম্প্রতিককালেও এমনটা দেখা গেছে। দেশের দুটো সর্বোচ্চ শিক্ষাপীঠে যে পৈশাচিকতা দেখা গেল তাকে কেবল দুর্ভাগ্যজনকই বলা যেতে পারে। কোনো নাম ধারণ করলেই যে মনের রঙ পাল্টে যায় না, তারও প্রমাণ মিলল। যে শুদ্ধাচারের গল্প শোনায়, সে অশুদ্ধ হলে তার প্রতিবিধান দ্বিগুণ তিন গুণ হওয়াই ন্যায়বিচার।
ndigantababar@gmail.com