বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এখন প্রতি মাসে বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ করছে সরকার। তার পরও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দামের বিশাল ব্যবধান থাকছে। বর্তমানে ভারতের কলকাতা ও বাংলাদেশের মধ্যে ডিজেল-পেট্রল লিটারপ্রতি পার্থক্য ২২ থেকে ২৫ টাকা। দামের এই বিশাল পার্থক্যের কারণেই বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা জ্বালানি তেল অবাধে পাচার হচ্ছে ভারতে।
দুই দেশের দামের পার্থক্য পাঁচ টাকার মধ্যে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এদিকে ডলার সংকটে আমদানি করা জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। অন্যদিকে ভারতে অবাধে পাচার হয়ে যাচ্ছে জ্বালানি তেল। এতে দেশের চাহিদা পূরণে সরকারকে বাড়তি তেল আমদানি করতে হচ্ছে, যার চাপ বাড়ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতে ডিজেলের দাম বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। এমন পরিস্থিতিতে চোরাচালান বাড়াটাই স্বাভাবিক। তাই দুই দেশের মধ্যে তেলের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। এতে তেল পাচারের ঝুঁকিও কমবে।
একই সঙ্গে বাড়তি তেল আমদানির চাপ ও জ্বালানি তেল পাচার বন্ধ করা গেলে সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর জ্বালানি তেল আমদানি ব্যয় মেটাতে সরকারকে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন হয়, তার ৭৩ থেকে ৭৫ শতাংশই ডিজেল আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে। চলমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের মধ্যে অবাধে জ্বালানি তেল পাচারের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সরকারকেও।
জানা গেছে, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ডিজেলের দাম বেশি হওয়ায় পাচারে সক্রিয় একটি অসাধুচক্র।
বিভিন্ন স্থলবন্দর ও সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন অলিখিতভাবে বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল। তেল পাচারের অভিযোগ স্বীকার করেছে দেশটির ট্রাকচালক ও সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দারাও। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশে তেলের মূল্য কম। ফলে পাশের দেশগুলো থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাকগুলোর তেলের ট্যাংক বাংলাদেশে ঢুকেই ভর্তি করা হয়।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভারতে তেল পাচারের বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। কোনো অবস্থায়ই দেশ থেকে জ্বালানি তেল পাচার হতে দেওয়া যাবে না।’
কলকাতায় প্রতি লিটার ডিজেল ৯১.৭৬ রুপিতে (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩০.৪৯ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ১০৫.৫০ টাকায়। কলকাতায় প্রতি লিটার পেট্রল ১০৪.৯৫ রুপিতে (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪৯.২৫ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি লিটার পেট্রল বিক্রি হচ্ছে ১২৭ টাকায়। এ অবস্থায় দুই দেশের ডিজেলের দামের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে প্রতি লিটারে ২৪.৯৯ টাকা এবং পেট্রলে ২২.২৫ টাকা। সীমান্তের এপার এবং ওপারের মধ্যে দামের এই ব্যবধানই সীমান্তের ভারতীয় অংশে জ্বালানি পাচারকারীদের কাছে বড় ব্যাবসায়িক সুযোগ বলে মনে করা হচ্ছে। এই সুযোগে সীমান্তে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি পাচারচক্র। ফলে বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ লিটার ডিজেল চোরাইপথে প্রতিবেশী দেশে ঢুকছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ডিজেলের দামের পার্থক্য ২৫ টাকার মতো। যার কারণে পাচার হচ্ছে। দুই দেশের জ্বালানি তেলের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনা গেলে অনেকটাই পাচার রোধ করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে পাচারের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হলেও পাচার কমে আসবে।’
বিভিন্ন স্থলবন্দরের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন দেশের বন্দরগুলো দিয়ে প্রায় এক হাজার ট্রাক আমদানি পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। তারা ফেরার সময় বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন বন্দর থেকে ট্যাংক পূর্ণ করে ডিজেল নিয়ে যায়। অনেকের আবার আলাদা ট্যাংকে করেও তেল নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বন্দর এলাকার বিভিন্ন তেলের পাম্প থেকে তেল এনে প্রতিবেশী দেশের ট্রাকচালকদের কাছে গোপনে বিক্রি করেন স্থানীয় তেল ব্যবসায়ীরা। এসব ট্রাকচালকের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাশের দেশে বিপুল পরিমাণ ডিজেল পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের সীমান্ত দিয়েও ডিজেল পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তবে বেনাপোলসহ বিভিন্ন বন্দরে এখন বিজিবির বাড়তি তৎপরতায় ডিজেল পাচারের প্রবণতা আগের তুলনায় কমেছে বলেও জানা গেছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যবধানের কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে তেল পাচার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, ‘মানুষের প্রত্যাশা এবং বিশ্ববাজারে তেলের দামের যে ফর্মুলা আছে, সব কিছু মিলিয়ে আমরা একটি ব্যালান্স করার চেষ্টা করব।’
স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, দেশে ২৪টি স্থলবন্দরের মধ্যে চালু আছে ১৫টি। এসব বন্দর দিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক কোটি ৮৭ লাখ ১২ হাজার ৪২ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়েছে। এই পরিমাণ পণ্য আমদানি এবং রপ্তানি করতে ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৫টি ট্রাক যাতায়াত করেছে। যেসব গাড়ি সীমান্তে পণ্য আনা-নেওয়া করে, সেগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি ধারণ করতে পারে। কোনো কোনো ট্রাকে আবার ৪০০ থেকে ৫০০ লিটার তেল নেওয়ার মতো ট্যাংকও আছে।
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/09/22/1427688