পাবলিক পরীক্ষায় অটোপাস বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তেমন একটা না দেখা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে তা বেশ ব্যাপকতা লাভ করেছে। এই অটোপাস নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। কারণ, মেধাবী শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা এতে সন্তষ্ট নন। পক্ষান্তরে স্বল্প মেধা সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিয়ে বেশ উৎফুল্লই বলা চলে। মূলত, মহামারি করোনার কারণে ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হয়নি এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। জেএসসির ২৫ শতাংশ ও এসএসসির ৭৫ শতাংশ ফলের ভিত্তিতে সেবার এইচএসসি অটোপাসের ফল প্রকাশ করা হয়। তবে এ ফল প্রকাশে মান বণ্টন, আইন সংশোধনসহ অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয় সরকারকে। বিষয়টি কারো কারো ক্ষেত্রে স্বস্তিদায়ক হলেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা ও মনন বিকাশে বড় ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি করেছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সে সময় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল তৈরি করতে গিয়ে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথমেই আসে যে দুই পরীক্ষার ভিত্তিতে গড় ফল তৈরি হয়েছে, সেটি। কেননা, জেএসসি পরীক্ষার সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকের বেশিরভাগ বিষয়েরই কোনো মিল নেই। বাংলা, ইংরেজি, আইসিটির মতো তিনটি বিষয়ের সঙ্গে যে মিল ছিল, সেটি নিতান্তই প্রাথমিক পর্যায়ের। এটির সঙ্গে এইচএসসির তুলনা ও সম্পর্ক স্থাপন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। তাই মূল্যায়ন পদ্ধতি ছিল রীতিমত ত্রুটিপূর্ণ।
অপরদিকে এসএসসি ও দাখিল পাসের পর শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিভাগ পরিবর্তন করেন। এ ক্ষেত্রে বিজনেস স্টাডিজ ও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মানবিক বিভাগে যান। আবার মাদরাসায় দাখিল ও এসএসসি ভোকেশনাল পাস করা অনেকে কলেজে ভর্তি হন। বিভাগ ও ধারা (মাদরাসা ও কারিগরি থেকে কলেজ) পরিবর্তনকারী শিক্ষার্থীদের ফল তৈরিও আরেক চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। জানা গেছে, ফল তৈরিতে প্রথম দিকনির্দেশনামূলক একটি প্রস্তাব তৈরি করা হয়। পরে সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই নির্দেশনার ভিত্তিতে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়। নীতিমালার আলোকে এইচএসসি-সমমান পরীক্ষার্থীদের গ্রেড পয়েন্ট নির্ধারণ করে ফল প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বিষয়টি মোটেই ন্যায়ত ও ইনসাফপূর্ণ ছিল না।
গ্রেড নির্ণয়কারী কারিগরি কমিটি থেকে বলা হয়, জেএসসি-এসএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে ২০২০ শিক্ষাবর্ষের এইচএসসির ফল তৈরি করা হয়। ওই দুই পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের এইচএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ দেয়া হয়। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজমুল হককে আহ্বায়ক এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে সদস্য সচিব করে আট সদস্যের একটি টেকনিক্যাল কমিটি কাজ করে। কমিটির সদস্যরা চারটি সভা করে একটি নীতিমালা তৈরির প্রস্তাব এবং ফল তৈরির কিছু দিকনির্দেশনামূলক প্রস্তাবনা তৈরি করে।
এদিকে এতদবিষয়ক নীতিমালা তৈরির উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়। শিক্ষা বোর্ড আইনে বলা আছে, পরীক্ষা নিয়ে বোর্ড ফল প্রকাশ করবে। কিন্তু করোনার কারণে সেবার পরীক্ষা হয়নি। ফল প্রকাশের পর আইনি জটিলতার মুখে পড়তে হয়। তাই জটিলতা এড়াতে সে বছর ডিসেম্বরে এইচএসির পরীক্ষার অটো পাসের বিষয়ে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে আইন সংশোধনের ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী। অটোপাস সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিধি না থাকায় আইনি জটিলতা এড়াতে আইন সংশোধন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
অপরদিকে ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে তিনটি পৃথক বিল উত্থাপন করেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে এ বিলের বিরোধিতা করেন একজন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যসহ বিরোধীদলের সংসদ সদস্যরা। পরে ১৯ জানুয়ারি করোনার কারণে পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসি ও সমমান ফল প্রকাশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকা, কারিগরি ও মাদরাসা বোর্ডের সংশোধিত আইন-২০২১ সংসদে উত্থাপন করা হয়। ২৪ জানুয়ারি পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে জাতীয় সংসদে তিনটি বিল পাস হয়। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী পরীক্ষা নেয়ার পর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল দেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সংশোধিত বিলে পরীক্ষা ছাড়াই বিশেষ পরিস্থিতিতে ফল প্রকাশের বিধান রাখা হয়।
২৫ জানুয়ারি এইচএসসি ও সমমান-২০২০ সালের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে আইন সংশোধন করে গেজেট জারি করে সরকার। সংসদে পাস হওয়া তিনটি বিলে রাষ্ট্রপতি সই করার পর তা গেজেট আকারে জারি করা হয়। ‘ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট-২০২১’ ‘বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (সংশোধন) অ্যাক্ট-২০২১’, ‘বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (সংশোধন) অ্যাক্ট-২০২১’ গেজেট আকারে জারি হওয়ায় এখন পরীক্ষা ছাড়াই বিকল্প মূল্যায়নের ভিত্তিতে ফল প্রকাশের বাধা কেটে যায়।
৩০ জানুয়ারি বেলা রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হয়। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে ফল প্রকাশের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। বেলা ১১টা থেকে মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা ও ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে ফল জানতে পারেন শিক্ষার্থীরা। ২০২০ সালে ১ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর কথা থাকলেও করোনার কারণে তা বাতিল করা হয়। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ শিক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করে।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বক্তব্য হলো, এইচএসসি পরীক্ষায় নানা স্তরের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এ কারণে সাধারণ স্তরের বাইরের পরীক্ষার্থীদের গ্রেড নির্ণয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়। তবে কেউ যেন তার প্রাপ্ত গ্রেড ও নম্বর থেকে বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়টির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে ফল প্রকাশ করা হয়। আর এভাবেই আমাদের দেশে শুরু হয় আত্মঘাতী অটোপাসের অভিযাত্রা।
বস্তুত, ২০১৯ সালের পর থেকে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্তের কারণে সার্বিক পাঠ্যক্রমের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য অটোপাসের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০২১ সালে শুধুমাত্র ছয়টি বিষয়ের ওপর এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রতিটি পরীক্ষা ছিল ৩২ নম্বরের। ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ের জন্য নির্ধারিত ছিল ৪৫ নম্বর। তবে এই দুই বছরই সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। করোনা মহামারির পরেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হয় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। সম্প্রতি ২০২৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে অটোপাসের সিদ্ধান্ত আসার পর এইচএসসি নিয়ে আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি রীতিমত আত্মঘাতী বলে উল্লেখ করছেন দেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদরা।
২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ মনে করছে, এই সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ছাড়াও এটি এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্যে বেশ দুঃখজনক। তারা বলছেন, ‘আমরা এই খবরটি শুনে অনেক ভেঙে পড়েছি। কারণ আমাদের মনে হচ্ছিল, আমাদের ব্যাচের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কেবল নিজেদের কথাই ভাবছে। দুই বছর ধরে একটি পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার পর সেই পরীক্ষা না দিতে পারা সত্যিই খুব কষ্টের। পুরো দেশ যখন অনেক রকম জটিল সমস্যা মোকাবিলায় ব্যস্ত, তখন জোরপূর্বক এই দাবি পূরণ করানো নৈতিকভাবে ঠিক নয় বলে আমি মনে করি।’
মেধাবী ও পরিশ্রমী শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, অটোপাসের সিদ্ধান্ত দ্বারা পরীক্ষার্থীদের এতদিনের পরিশ্রমকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। তারা বলছেন, ‘অনিশ্চয়তা ও বারবার সিদ্ধান্ত বদল শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে মানসিক সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলেছে। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে অ্যাকাডেমিক বিষয় ছাড়াও অনেক কিছু জড়িত। ভবিষ্যতে দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার সময় এই ব্যাপারটি সমস্যার কারণ হতে পারে। এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিকেও আরও জটিল করে তুলেছে।’
এ বিষয়ে একজন ভুক্তভোগীর বক্তব্য হচ্ছে, তিনি ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে বেশ কঠিন সময় পার করছেন। কারণ এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারলে তার আত্মবিশ্বাস এবং প্রস্ততি দুটোই বৃদ্ধি পেত। এর ফলে এখন আমি দ্বিধায় ভুগছি যে, আমার কি একেবারে প্রথম থেকে শুরু করা উচিত নাকি কোচিং আর প্রাইভেট টিউশন নিয়ে ভর্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। এইচএসসি অনেকের জন্য একটি বাস্তবতা হিসেবে কাজ করে। যদি কারো এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হয়, তাহলে সে ভর্তি পরীক্ষার মৌসুমে কঠোর পরিশ্রম করে ভালো জায়গায় ফিরে আসতে পারে। কিন্তু অটোপাসের সিদ্ধান্তের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষার জন্য তাদের প্রস্তুতি যাচাই করতে পারবে না।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বুয়েট) ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলসের (বুটেক্স) মতো বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট নম্বর ও গ্রেডিং প্রয়োজন। যেহেতু এবার বেশিরভাগ বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি, তাই যারা এসব জায়গায় ভর্তির জন্য কঠোর পরিশ্রম করছিল, তাদের জন্য সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক ও ইনসাফপূর্ণ নয়। যেসব শিক্ষার্থীরা অক্টোবর ও নভেম্বরে স্যাট পরীক্ষা দিতে চেয়েছিল, তারা একটি কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। আকস্মিক এই অটোপাসের সিদ্ধান্তের ফলে তারা প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছে না এবং এবারের ফল সেমিস্টারে দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় আছি আমি’।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অটোপাসের সিদ্ধান্তের ফলে কিছু শিক্ষার্থীকে অনেক তাড়াহুড়ো করে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করতে হয়েছে। তারা আশা করেছিলেন এইচএসসি স্থগিত হয়ে যাবে অথবা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে সেপ্টেম্বরের দিকে অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য তারা ভর্তির প্রস্তুতি শুরু করতে তৈরি ছিল না। কিন্তু এখন তাদের আগের সব পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দ্রুত ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। আগে প্রতিদিন অল্প করে রিভিশন দেয়া ও সিনিয়রদের থেকে পরামর্শ সুযোগ থাকতো। কিন্তু কোচিং ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ায় হঠাৎ করেই চাপ বেড়ে গেছে’।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কলেজের একজন শিক্ষার্থীকে তার এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে যাচাই করা যায় না। আর অটোপাস একজন শিক্ষার্থীর কলেজ জীবনের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়। অনেক শিক্ষার্থীকে দেখা গেছে, যারা স্কুলে অতটা মনোযোগী না হলেও কলেজে বেশ মনোযোগী হয়ে উঠে। কিন্তু ২০২০ সালে অটোপাসের সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর তাদের সব চেষ্টা বিফলে গেছে এবং তারা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাই দিতে পারেনি। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষার যে ধারা সৃষ্টি হয়েছে, এটিও ভীষণ ক্ষতিকর। যদি পুরো এইচএসসির সিলেবাসটি দেখা যায়, তাহলে লক্ষ্য করা যাবে যে প্রতিটি অধ্যায় একটি অপরটির সঙ্গে সম্পর্কিত। স্নাতকের কিছু কোর্সের বিষয়ের সঙ্গে মিল থাকায় একজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার জন্য প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। কেউ যদি এই বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচিত না হয়, তাহলে তার এইচএসসি সার্টিফিকেট মূল্যহীন হয়ে পড়বে। আমরা বুঝতে পারি যে কোভিড মহামারি পরিস্থিতির কারণে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তবে এই সিদ্ধান্ত বারবার চালিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি; যৌক্তিক নয় বরং তা শিক্ষাক্ষেত্রে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, সম্প্রতি অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের দেয়া এই অটোপাসের সিদ্ধান্তের ফলে সরকার নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। যেহেতু ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থী অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে এই সিদ্ধান্ত দিতে কিছুটা বাধ্য করেছে, তাই ভবিষ্যতেও দেখা যাবে পরবর্তী ব্যাচের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা নিজেদের স্বার্থের জন্য পরীক্ষা পেছানো বা অটোপাসকে তাদের যেকোনো সমস্যার সমাধান মনে করবে’।
কীভাবে অটোপাসের সিদ্ধান্ত যোগ্য প্রার্থীদের জন্য ঠিক নয়, তা ব্যাখ্যা করে শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এসএসসিতে ভালো ফলাফল না করায় যারা কলেজে সত্যিই খুব মনোযোগী হয়ে উঠেছিল, তাদের জন্য এই সিদ্ধান্ত শাস্তিস্বরূপ এবং রীতিমত অস্বস্তিকর। কলেজে দুই বছরে প্রতি সপ্তাহে অসংখ্য কুইজ আর প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার দেয়ার পর এই অটোপাস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মনে হয়, যেসব শিক্ষার্থীরা অটোপাসের জন্য আন্দোলন করেছে, তারা কেবল সার্টিফিকেটের কথা চিন্তা করেছে, এইচএসসি পরীক্ষার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা করেনি’ বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য এই অটোপাসের সিদ্ধান্তের পর সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে? সংশ্লিষ্টদের কাছে সে প্রশ্নেরও কোন উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
মূলত, আগামী ব্যাচের জন্য কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে যেন এইচএসসি পরীক্ষা একজন শিক্ষার্থীর যোগ্যতার সঠিক প্রতিফলন ঘটাতে সাহায্য করে। তাই ভবিষ্যতে যতই প্রতিকূল পরিস্থিতি আসুক, কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার্থীদের যেন সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। পাশাপাশি কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও শিক্ষার্থীদের সমস্যা বিবেচনা করে ভর্তি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে নমনীয় হতে হবে। এ ধরনের বাস্তব সমাধান এই প্রতিকূল সময়ে শিক্ষার্থীদের চাপ কমিয়ে তাদের স্বস্তি দিতে পারে।
শিক্ষার্থীদের একাংশ দাবি করছে, ২০২৪ সালের এইচএসসির ফলাফল তাদের অংশগ্রহণ করা সাতটি পরীক্ষার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। তারা বলছেন, যে মেধাভিত্তিক ব্যবস্থার জন্য শিক্ষার্থীরা লড়াই করেছেন, সেখানে অটোপাস মেধাভিত্তিক ব্যবস্থার অপমান। একটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা যতই আন্দোলন করুক না কেন, সরকারের এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়া উচিত না। যদি ভবিষ্যতে আর কোনো বোর্ড পরীক্ষা এভাবে বাতিল হয়ে যায়, তাহলে মেধাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে। তাই এবারের ব্যাচের জন্য শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়ে বলছেন, যেসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে তার ভিত্তিতেই ফলাফল দেয়া উচিত। যেহেতু অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি ও পদার্থবিজ্ঞান এই দুইটি বিষয়ের নম্বরকে বেশি গুরুত্ব দেয়, তাই যেসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতে ফলাফল দেয়াটাই যৌক্তিক। আর সেটাই হবে ন্যায়সঙ্গত ও ইনসাফ মাফিক।
সার্বিক দিক বিবেচনায় একথা বলা যায় যে, আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে যে অটোপাস পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে, তা কোনভাবেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মেধা ও মনন বিকাশে সহায়ক নয় বরং শিক্ষা ক্ষেত্রে রীতিমত নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এতে মেধাবী ও পরিশ্রমী শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাপ্য ও যথাযথ মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, পক্ষান্তরে স্বল্প মেধাবীরা অতিমূল্যায়নের কারণে মেধার জগতে রীতিমত শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। যা আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য মোটেই ইতিবাচক নয়। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে অটোপাস পদ্ধতি বাতিল করে শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়ন বিকল্প পদ্ধতি অবিষ্কার করা দরকার। আর এবারকার জন্য গৃহীত পরীক্ষার ভিত্তিতেই ফলাফল ঘোষণা করা উচিত। অন্যথায় মেধার জগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা কোনভাবেই পূরণ করা সম্ভব হবে না।